তাতাবাবুর বুলবুলভাজা

ডিসেম্বর ৬, ২০১৩

RoySukumar

নিত্যানন্দ খা: সুকুমার রায়কে নিয়ে কথা বলতে হলে, দুর্গম পুরনো লাইব্রেরির ধুলোপড়া আলমারির এলোমেলো দুষ্প্রাপ্য বইয়ের মধ্যে থেকে তাঁর বই খুঁজে বার করতে হয়না। তিনি বাঙালি বিশেষত লেখাপড়া-জানা-বাঙালির ঘরেই থাকেন। তাঁকে বাচ্চাদের লেখক বললে সবটা বলা হয়না। আবার শুধুই বড়দের বলে দেগে দিলে, অতিশয়োক্তি ঘটে। ফলে একান্ত ভাবেই কাম্য, তাঁকে নিয়ে পাঠকে-পাঠকে ছাড়াছাড়ি না-হয়ে বরং কাড়াকাড়ি হোক।

সুকুমার রায় রসিক কবি। তবে ‘নব রস’-এর নয়। নবীন রসের। সে রস ‘খেয়াল রস’। বাংলা সাহিত্যে এই খেয়াল রসের ধারা তিনি বয়ে এনেছেন তাঁর রচনার মাধ্যমে। সুকুমার, কাব্য ও ছড়া বিষয়ক তিনটি বই লিখেছেন। ‘অতীতের ছবি’, ‘আবোল-তাবোল’ ও ‘খাইখাই’। প্রথম গ্রন্থটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল।কিন্তু পরের দুটি মৃত্যুর পর। এছাড়া এদিকে অদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘অন্যান্য কবিতা’।

আমার মনে হয়, সুকুমারের কবিতার অধিকাংশ মজার সূত্র হচ্ছে ‘আবোল-তাবোল’। এ ক্ষেত্রে আরেকবার তাঁর হয়ে আমি বলে রাখি-

“যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়ালরসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করতে পারেন না, এ-পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে”

‘আবোল-তাবোল’ কথাটা ইংরাজি ‘নন সেন্স’ কথাটার সার্থক বাংলা বলে অনেকে মনে করেন। তবে এ নয় পাগলের যা-খুশি-তাই বকুনি কিংবা নেশাগ্রস্থের প্রলাপ। সুকুমারের কবিতার আবোল-তাবোল তৈরী হয়েছে গভীর সচেতন ভাবনা চিন্তা থেকে। অন্যদের ক্ষেত্রে এরকম কাজে কিছুটা কোস্তাকুস্তির ঘামজল বেরিয়ে পড়ে, সুকুমারের ক্ষেত্রে তা যে হয় না, তার কারণ তাঁর প্রতিভার চরিত্রই আলাদা। এর ধড়, তার মুড়ো ইত্যাদি আবোল-তাবোল জুড়ে দেওয়ার পাশাপাশি সুকুমার ননসেন্সের সঙ্গে গহন কবিতাকেও বুনে দিয়েছেন। তাই নক আউটের পরেও প্রতিপক্ষ বুঝতে পারে না, খেল-খতম অনেকক্ষণ! 

“হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা”

পৃথিবীতে কী হতে পারে আর কী হতে পারে না, এ সম্বন্ধে আমাদের অনেকের ধারণা খুব ছোট বাক্সের মধ্যে এঁটে যাবে। কিন্তু সুকুমার আর একটা আস্ত বিকল্প অসম্ভবের পৃথিবীকেই যেন তাঁর মস্তিষ্কে বহন করেছেন। মুহুর্তের মধ্যেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে আশ্চর্য জীবজন্তু যারা যতটা মারাত্মক তাঁর চেয়ে অনেক বেশি মজার। আসছে অদ্ভুত মানুষের দল, যাঁদের কথাবার্তা, আচার, ভাবনা, পরিবেশ সবই বীভৎস রকমের মজাদার। ভাষার ব্যকরণ আর কল্পনার ব্যকরণ, দুইয়েরই সব গলিঘুঁজি তাঁর ছিল পরিষ্কার জানা।

গম্ভীর্য আর পণ্ডিতি, দুটোই ঘোরতর অপছন্দ ছিল সুকুমারের। তাঁর নাটকে ঘুরে ফিরে এসেছে সেই চরিত্রগুল, যারা আদতে অকাট মূর্খ, নির্বোধ, নির্লজ্জ, সুযগসন্ধানী অথচ দুরারোগ্য পন্দিতন্মন্যতায় ভোগে। কোনও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নাটক রচনা না হলেও কতকগুলো পড়লে মাঝে মাঝে সমাজভাবনা, জীবনদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। অনেক নাটকের পাণ্ডুলিপি আজ আর পাওয়া যায় না ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে দুই একটা সেই সময় রায় বাড়ির সকলকে মজা দিয়েছিল। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর লেখা ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ পড়লেই এই বিষয়ে জানা যায়-

“এতদিন ছোটদের জন্য যেসব নাটক ও গল্প বইয়ে কিংবা পত্রিকায় বেরত, তাই নিয়েই অভিনয় হত, এবার দাদা নিজেই হাসির নাটক লিখতে আরম্ভ করল।”

শুধু নাটক রচনায় নয়, অভিনয়েও অসাধারণ ছিলেন সুকুমার। ফলে কৌতুক, সমাজভাবনা, জীবনবোধ স্বাভাবিক ভাবেই উঠে এসেছিল তাঁর নাটকগুলিতে। উদ্ভট ছড়া লেখার পাশাপাশি নাটক রচনাতেও বিখ্যাত হয়ে রইলেন তিনি।

“রামধনুকের আবছায়াতে”

আশ্চর্য ইলাস্ট্রেটার সুকুমার। এমন কী অবন ঠাকুরের খাতাঞ্চির খাতার সঙ্গে তিনি যে কেজো মানচিত্রটি আঁকেন, তাতে মুরগিহাটার আকৃতি মুরগির, পতলডাঙ্গার চেহারা পটলের, বৌ বাজার যেন খোঁপা-বাঁধা বৌ।

‘আবোল-তাবোল’ এর মতো ‘হযবরল’ ও ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারির ডায়েরী’ তে সুকুমার অভুত ঘটনার সঙ্গে ছবি এঁকে অভুত মজা ছড়িয়েছেন। ‘হযবরল’ এর ‘কাক’, ‘হুঁকো হাতে দাঁড়িওয়ালা বুড়ো’, ‘প্রফেসর হিজিবিজবিজ’ অসাধারণ। ‘মানহানির মোকদ্দমা’ পর্বে বিচারালয়ের ছবিতে শিয়াল, ন্যাড়া, প্যাঁচা, কাকেশ্বর কুচকুচ ইত্যাদির যে বৈঠকি মেজাজ এনেছেন তা মনে রখার মতো। সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসা বিড়ালের ছবিটি। ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারির ডায়রী’-র হুঁশিয়ারই তো সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর প্রেরণা। সমালোচক মৃণাল ঘোষ বলেছেন-

“কবিতা বা কাহিনীর সঙ্গে এই ছবিগুলো প্রথম দেখলে মনে হয় বৈজ্ঞানিক ভাবে এদের অবয়ব কল্পনা থেকেই হয়তো পরে সূত্রপাত হয়েছে লেখায় এদের রূপবর্ণনা। এদের মধ্যে বিজ্ঞানের সত্য, বাস্তবতার সত্য ও অপ্রাকৃতের সত্য এক জায়গায় এসে মিলে গেছে যেন।” 

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, বিশ্ব সাহিত্যে লুইস ক্যারলই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর ছবিতে ছড়ার স্বাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ লেখাকে অনুসরণ করে ছবি নয়, ছবিকে অনুসরণ করেই লেখা। এই ধারাটা বাংলা সাহিত্যে প্রথম নিয়ে এলেন সুকুমার। ছবিতে উদ্ভট ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি মুখাবয়ব ও শরীরের ভাবব্যঞ্জক দিকগুলির পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন। এই ধরণেরে ছড়াগুলো ছবি ছাড়া অসম্পূর্ণ। পুণ্যলতা চক্রবর্তী লিখেছেন-

“দিদি দাদা আর টুনির ছবি আঁকার হাত খুব সুন্দর ছিল। দিদি ফুল-পাতা, পাখি- গাছপালা ইত্যাদি সুন্দর জিনিসের ছবি আঁকতে ভালবাসত, আর দাদার প্রধান ঝোঁক ছিল মজার ছবির উপর। দাদার বই খাতা কত মজার মজার ছবিতে ভরা থাকত, পড়ার বইয়ের সাদা-কালো ছবিগুলি সব রঙিন হয়ে যেত।”

 

‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ সম্পাদনা কালে প্রতি সংখ্যায় তিনি কাগজের প্রচ্ছদ, ভেতরের ছবি সবই আঁকতেন। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য ‘পঞ্চ-তিক্ত-পাঁচন’ সম্পাদকীয় মজার লেখাটি। ছবি দেখে যেমন মজা পাওয়া যেত, তেমনি এই লেখাতেও ছিল মজা। উড এন গ্রেভার পদ্ধতি ছবি ছাপার ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোরকে বড়ই পীড়া দিয়েছিল। তাই জন্যেই তাঁর হাফটোন বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা। সুকুমার সেই ধারাকে নতুন আঙ্গিকে ছবিকে দেখালেন।

 

“কল্পনার দুই পৃথিবীঃ পাগলা গারদ ও চিড়িয়াখানা”

নিছক ভাষানির্ভর মজা থেকে কল্পনানির্ভর মাজাকে আলাদা করা সম্ভব। এর দুটি প্রধান শাখা আছে। একটি হল, মানুষের জগতের নানা চরিত্র, প্রাণ ইত্যাদির অতিরঞ্জিত, অভাবিত বা উদ্ভট কথাবার্তা ও আচরণ, চেনা পৃথিবীর মধ্যে অচেনা কাণ্ডকারখানা। এখানে সম্ভবকে অল্পবিস্তর অতিরঞ্জিত করেন সুকুমার। খুব কম ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্যকে প্রশ্রয় দেন। একটি ইংরাজি কথা ব্যবহার করে বলি, পাগলা গারদের চরিত্রগুলো মূলত তাঁর ‘Discovery’ আর একটি হল, অসম্ভব সব প্রাণীদের ভিড়ে ঠাসা, সুকুমারের সৃষ্ট এক নতুন চিড়িয়াখানা। এগুলো মূলত তাঁর ‘Invention’ বলা যেতে পারে। একটা ‘আবিষ্কার’ আর একটা ‘উদ্ভাবন’। এইনিয়েই সুকুমারের দুই পৃথিবী।

প্রথমে পাগলা গারদে ঢুকে পড়া যাক। এ পাগলরা মোটেই ভয়ংকর নয়; বেশ মনোরম, হৃদয়গ্রাহী। পাগল না- বলে বাতিকগ্রস্থ বলা যায়। যেমন আবোল-তাবোলের কাঠবুড়ো। সে- বুড়ো আমাদের খুব অচেনা নয়, এরকম খ্যাপাটে বুড়ো আগে প্রায়ই দেখা যেত। কিন্তু তার কাঠ সেদ্ধ করার ব্যাপারটাই সুকুমারের নতুন কল্পনা, আর সেটাই বুড়োর কাঠ সংক্রান্ত নানা ও আচরণ নিয়ে, এই কবিতার মজার ভিত্তি। হেড আপিসের বড়বাবু তো কতই ছিল বা আছে, কিন্তু তাদেরই একজন যে তাঁর গোঁফ চুরি গিয়েছে বলে খেপে যাবে তা কে ভাবতে পেরেছিল? আসলে প্রচুর খ্যাপাটে লোক জোগাড় করেন সুকুমার, যাদের সকলেরই কোনও- না- কোন বিষয়ে কমবেশি পাগলামো আছে।

এবার তাঁর আজব চিড়িয়াখানায় একটু ঘুরে আসি। এ ধরণের কল্পনা পৃথিবীর সাহিত্যে নতুন নয়, গালিভারের বৃত্তান্ত থেকে বহু বহু কল্পকথাতে এ ধরণের বিচিত্র জীবজন্তুর দেখা মেলে। আবোল-তাবোলে ‘খিচুড়ি’ জাতীয় প্রাণীদের দিয়ে তা শুরু হয়, তারপর আমরা একে একে পাই কুমড়োপটাশ, হুঁকোমুখোহ্যাংলা, পান্তভূতের জ্যান্তছানা, রামগরুড়ের ছানা, ট্যাঁশগোরু, ভয়- পেয়ো- নার সেই মিষ্টি- কথা বলা দৈত্যটি।

“স্বপ্ন ঘোড়ার চড়নদার”

ছোটদের আনন্দদানের যে গুরু দায়িত্ব রায় পরিবার নিয়েছিল, পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের পর, সুকুমার রায় তা পালন করে গেছেন আজীবন। এক কথায় সুকুমার রায় শিক্ষিত বাঙালির ঘরের কবি। তাঁর কাছে আমাদের যত না দাবী, তাঁর থেকে আমাদের প্রাপ্তি অনেক বেশি। সাইবার ও অ্যানিমেশন মণ্ডিত সময়ের এই সত্রেও তাই আশা করা যায়, সুকুমার রায় ও তাঁর জগৎ শিশুদের আকর্ষণ করতে সক্ষম। তাই এখনও ব্যাটম্যান আর হ্যারিপটারে ক্লান্ত হয়ে ঘুম জড়িয়ে আসা চোখে, শিশুর নির্ভরযোগ্য সঙ্গী, স্বপ্ন ঘোড়ার চড়নদার সুকুমার রায়, ওরফে তাতাবাবু।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ

১) সুকুমার রায়, ‘আবোল-তাবোল’ (১৯৪৫)।

২) সত্যজিৎ রায়, ‘সুকুমার সমগ্র’, প্রথম খণ্ড(২০০৬)।

৩) পুণ্যলতা চক্রবর্তী, ‘সুকুমার রায়ঃ শিল্প ও সাহিত্য’ (১৮৮৯)।

৪) ঐ, ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ (১৯৯৬)।

যাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ

১) অধ্যাপিকা ব্রততী চক্রবর্তী।

২) অধ্যাপক সুখেন বিশ্বাস।

 

ঢাকা জার্নাল, ডিসেম্বর ৬, ২০১৩।

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.