সন্ন্যাসী হয়ে ফিরে আসে মৃত রাজা

ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫

Mejhu Kumarঢাকা  জার্নাল: ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বহুল আলোচিত ও সাড়া জাগানো মামলা ছিল ভাওয়াল রাজার মামলা। মামলাটি অধিক পরিচিতি পেয়েছিল ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা’ নামে । সে সময় বঙ্গে মানুষের মুখে মুখে গল্প আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার কথা। রচিত হয় গান, কবিতা, নাটক, যাত্রাপালা। নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালত হয়ে যে মামলা সর্র্বশেষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ও শেষ আদালত ’প্রিভি কাউন্সিল’ পর্যন্ত গড়ায়।
মামলার ঘটনা তৎকালীন পূর্ববাংলার এক বিখ্যাত জমিদারীকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববাংলায় দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি ছিল ভাওয়াল জমিদারি, বর্তমানে যা গাজীপুর জেলার অন্তর্গত। পরিধি ও আয়ের দিক থেকে সর্ববৃহৎ জমিদারি ঢাকার নবাব এস্টেটের পরেই ছিল ভাওয়ালের অবস্থান।

অষ্টাদশ শতকের শুরুতে অর্থাৎ ১৭০৪ সালে ‘শ্রীকৃষ্ণ’ ভাওয়াল জমিদারী অধিকার করে নেয়। তার আগে এই জমিদারীর মালিক ছিল ভাওয়াল গাজীগণ। গাজীদের দেওয়ান ছিলেন কৃষ্ণের পিতা, যার পৈত্রিক নিবাস বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামে। সে সময় মুঘল শাসিত পূর্ববাংলার দেওয়ান ছিলেন মুর্শিদকুলী খান। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তিনি একটি বিশেষ নীতি গ্রহণ করেন। তারই অংশ হিসেবে স্থানিয় বেশিভাগ মুসলমান জমিদারদের উচ্ছেদ করে তার স্থলে নিযুক্ত করেন হিন্দু জমিদার।

শ্রীকৃষ্ণ পরিবারের জমিদারীর প্রায় পৌনে দুইশত বছরে, ১৮৭৮ সালে জমিদার কালীনারায়ণ ব্রিটিশ রাজের নিকট থেকে বংশানুক্রমিক রাজা উপাধি লাভ করেন। এরই মধ্যে পরিবারটি আশপাশের ছোট বড় অনেক জমিদারী কিনে নেয়। জমিদারীর বিস্তৃতি ঘটে ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত। অবশেষে ব্রিটিশ নীলকর জেমস্ ওয়াইজ এর জমিদারী কিনে নিয়ে সমগ্র ভাওয়াল পরগনার অধিকারী বনে যায়।

প্রায় দুইশত বছরের দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর ১৯০১ সালে রাজ পরিবারে নেমে আসে এক ঘোর সংকট। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুতে জমিদারী রাজা শুণ্য অবস্থায় পতিত হয়। তার তিন পুত্র রণেন্দ্রনারায়ণ, রমেন্দ্রনারায়ণ এবং রবীন্দ্রনারায়ণ। নাবালক হওয়ার দরুণ তখনই তারা কেউ পরবর্তী রাজা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারলেন না। বিধি মোতাবেক জমিদারী  নির্বাহ ও তত্বাবধায়নের দায়িত্ব চলে যায় ’কোর্ট অব অর্ডার’ এর অধীনে।

ব্রিটিশ আমলে কোর্ট অব অর্ডার ছিল একটি সরকারী দফতর, যা মালিকানাহীন জমিদারীর তত্ত্বাবধায়ণ  করত। জমিদারীর মালিক নাবালক অথবা জমিদারী  চালাতে অক্ষম হলে সেই এস্টেট এই দফতরের আওতায় চলে যেত। ১৯০৯ সালে মেজ রাজপুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ জটিল রোগে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। উন্নত চিকিৎসা ও বায়ু পরিবর্তনের  জন্য ২৪ বছর বয়সে তাকে দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে একটি ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়, দার্জিলিং পৌঁছার ঠিক পনের দিন আগে তিনি একটি দারুণ ঘটনা ঘটান। পরগনার শালনা জঙ্গল থেকে একটি রয়েলবেঙ্গল টাইগার শিকার করেন। ধরাশায়ী  হওয়া বাঘটির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি একটি ছবি তোলেন। ছবিটি পরবর্তীতে ‘টাইগার ফটো’ বলে পরিচিতি পায় এবং বিংশ শতকের অন্যতম ছবি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশ আর্কাইভে স্থান পেয়েছে ছবিটি।

যাহোক, তিনি এপ্রিলের ২৫ তারিখে দার্জিলিং পৌঁছেন এবং চিকিৎসা চলা অবস্থায় পরের মাসের ৮ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর রাজবাড়িতে শুরু হয় নতুন সমস্যা। রমেন্দ্রের স্ত্রী বিভাবতী দেবীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ভাওয়াল এস্টেটের সম্পত্তিতে তার বোনের অংশ সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট হলেন।

কথিত আছে, একটা নির্দিষ্ট পরিমান মাসোহারা দিয়ে বিভাবতীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার প্রস্তাব উঠেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সত্যেন্দ্রনাথ তা মেনে নিতে পারলেন না। এই পরিস্থিতিতে তিনি আইনগত দিকগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে দেন। সে উদ্দেশ্যে কলকাতায় উকিলের শরণাপন্ন হলেন। এই হলো ঘটনার একটি দিক।

অন্যদিকে এটাও কথিত আছে, এস্টেটের ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ অতিরিক্ত নাক গলানোর চেষ্টা করছিলেন। মূলত তাকে ঠেকাতেই রাজ পরিবারে এমন প্রস্তাব উঠেছিল। তিনি তার বোনকে রাজবাড়ি ছেড়ে চলে আসার জন্য বোঝাতে থাকেন। বিভাবতী প্রথমে রাজী না হলেও অল্পদিন পরই রাজবাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের সঙ্গে চলে যান। নভেম্বর মাসে আমমোক্তারনামা লিখে সত্যেন্দ্রনাথকে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। একই সঙ্গে এস্টেটের কাছে তার স্বামীর জন্য করা বিমার ত্রিশ হাজার টাকা দাবি করলেন। ভাওয়াল রাজ বাড়িতে যেন বিভিষিকার কাল মেঘ নেমে এল।

রমেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর সোয়া বছরের মাথায় ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বরে মারা গেলেন তার বড় ভাই রণেন্দ্রনারায়ন। পরের বছর এপ্রিলে কোলকাতায় অবস্থানরত মেজরাণী অর্থাৎ রমেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী বিভাবতী এস্টেট ম্যানেজার মি. নিডহ্যামের মাধ্যমে জানতে পান তার অংশের সম্পত্তি কোর্ট অব অর্ডার অধিগ্রহণ করেছে।

একই বছর মে মাসে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর ছোট রাজপুত্র রবীন্দ্রনারায়ণকে জমিদারী  চালানোয় অনুপযুক্ত ঘোষণা করে এবং তার অংশও কোর্ট অব অর্ডারের অধীনে চলে যায়। সবশেষে ১৯১২ সালে রণেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী সূর্যবালার অংশ কোর্ট অব অর্ডারের অধীনে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ভাওয়াল জমিদারীটিই এই দফতরের অধীনে চলে যায়। ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যু হয় ছোট রাজপুত্র রবীন্দ্রনারায়ণের। পূর্ববাংলার বৃহত্তম জমিদারী ভাওয়াল রাজপরিবারে বাকি থাকল কেবল নিঃসন্তান তিন বিধবা রাণী।

ওদিকে মেজকুমারের মৃত্যুর পর থেকেই গুজব রটেছিল তার দেহ নাকি ভালোভাবে সৎকার করা হয়নি। এবার শোনা যেতে লাগল যে, তিনি নাকি জীবিত আছেন এবং সন্ন্যাসী জীবনযাপন করছেন। নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভারত, নেপাল ও তিব্বতের বিভিন্ন জায়গায়। এই পরিস্থিতিতে খোঁজ নিতে রাজবাড়ি থেকে উত্তর ভারতে লোক পাঠানো হয়।

১৯১৭ সাল নাগাদ গুজবের স্রোত প্রবল হয়ে উঠে, যখন কুমারদের বৃদ্ধা ঠাকুরমা রাণী সত্যভামা দেবী  স্বউদ্যোগে বর্ধমান মহারাজের কাছে খবর নিতে পত্র পাঠালেন। তার আগে কুমারদের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবী বিষয়টি সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চিত হয়েছিলেন। ধর্মকর্মের উদ্দেশ্যে তিনি প্রায়ই কাশি যেতেন। সেখানে গিয়ে সন্নাসীদের কাছে খোঁজ নিয়ে তিনি কুমারের জীবিত থাকার কথা জানতে পারেন।

এরই মধ্যে মেজকুমারের মৃত্যুর ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস নাগাদ ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে (আহসান মঞ্জিলের সামনে দিয়ে সদরঘাট লঞ্চটার্মিনাল যাওয়ার পথটিই বাকল্যান্ড বাঁধ বলে পরিচিত ছিল) এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। জটা ধরা ছাই মাখা হলেও তাকে দেখে অনুমান করা যেত যে, নিশ্চয় কোন উচ্চ বর্ণের সন্তান। ঘটনাক্রমে গুজবের মুখ এবার ভাওয়াল রাজবাড়ির দিকে মোড় নিতে থাকল। কানে কানে রটে গেল মেজকুমার ফিরে এসেছে, জটা ধরা সন্ন্যাসীই রাজপুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ। ঘটনা পরখ করার জন্য রাজ পরিরার থেকে লোক পাঠান হলো। মেজকুমারের চেহারার সঙ্গে মিল আছে ঠিকই কিন্তু তারা ফিরে এসে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না।

শুরু হল নানা প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নীরিক্ষা। সন্ন্যাসীকে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর ভাওয়াল রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এস্টেটের সেক্রেটারি  রায়সাহেব যোগেন্দ্রনাথ বাঁড়–জ্যে ভালোভাবে দেখেন এবং সন্ন্যাসীকে মেজকুমার বলেই সন্দেহ করলেন। সেখান থেকে তাকে জ্যোতির্ময়ী দেবীর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় অন্তরঙ্গ পরীক্ষা-নীরিক্ষা। সবকিছুর পর জ্যোতির্ময়ীর সন্দেহ গভীর হতে লাগল যে, এই সন্ন্যাসীই তার ভাই। পরের দিন আরও এক দফা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। তার শরীরের পুরনো চিহ্নগুলো দেখে জ্যোতির্ময়ী  নিশ্চিত হন এ তার ভাই রমেন্দ্রনারায়ণ। বোনের অনুরোধে সন্ন্যাসী বাইরে সমবেত প্রায় দুই হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী বলে পরিচয় দেন। রাজপুত্রের আগমনে আবেগপ্রবণ সমবেত জনতা তার আগে তার অতীত জীবন থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন করে নিশ্চিত হয়ে নেয়। অবশেষে ’জয় মধ্যকুমারের জয়’ বলে ধ্বনি দিতে থাকে।

পরের দিন ৫ মে এস্টেটের ম্যানেজার নিডহ্যাম সমস্ত ঘটনার বিবরণ জানিয়ে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিন্ডসে-কে একটি গোপন প্রতিবেদন পাঠান। একইসঙ্গে প্রতিবেদনের কপি কলকাতায় মেজরাণী ও অন্যান্য দুই রাণীকেও অবহিত করার জন্য পাঠান। ঘটনার ধারাবাহিকতায় সে মাসেরই ১৫ তারিখে জয়দেবপুর রাজরাড়ি মাঠে এক সমাবেশের ডাকা হয়। হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণের জন্য সেদিন রেল কোম্পানিকে অতিরিক্ত বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে হয়েছিল বলে জানা যায়।

সমাবেশে ভাওয়ালের এক গণ্যমান্য তালুকদার আদিনাথ চক্রবর্তী মেজ কুমারের কথিত মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণ দেন। অতঃপর সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে প্রথমে যারা বিশ্বাস করে সন্ন্যাসীই ভাওয়াল মেজকুমার তাদেরকে হাত তুলতে বলেন এবং যারা বিশ্বাস করে না তাদেরকে পরে তুলতে আহ্বান করেন। দেখা গেল দ্বিতীয় আহ্বানে একটি হাতও উঠল না। সেখানেই ভাওয়াল রাজের আর এক তালুকদার পূর্ণচঁন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাওয়াল রাজের তালুকদার ও প্রজা সাধারণের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করেন যে, সন্ন্যাসীকে ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায় বলে মেনে নেওয়া হলো। বিনা বিরোধিতায় তা পাস হয়ে যায় এবং স্থির হয় প্রস্তাবের কপি গভর্ণর, বোর্ড অব রেভিনিউ, এডিশনাল কমিশনার ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠান হবে।

সন্ন্যাসীকে সকলেই মেজকুমার বলে বিশ্বাস করলেও মেজরাণী বিভাবতী ও তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। ওদিকে এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের পক্ষেও তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ক’দিন বাদেই গঠন হয় ‘ভাওয়াল তালুকদার ও প্রজা সমিতি’। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য হল কুমারের ন্যায্য অধিকার আদায় করার জন্য চাঁদা তোলা।

২৯ মে মেজকুমার দুজন উকিল ও স্থানীয় এক জমিদারকে নিয়ে হাজির হন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিন্ডসের নিকট। প্রজা সাধারণের স্বার্থে তিনি নিজ অধিকার ফিরে পেতে চান বলে তাকে অবহিত করেন। লিন্ডসে জানালেন বোর্ড তা মেনে নিতে পারে না, কারণ মেজকুমার মৃত জেনেই বোর্ড বহু বছর ধরে এস্টেটের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, চাইলে তিনি নিজের পরিচয় আদালতের সামনে প্রমাণ করতে পারেন।

পাঁচ দিন পর বোর্ড অব রেভিনিউ ইস্তেহার জারি করে বলে, বার বছর পূর্বে দার্জিলিং-এ মেজকুমারের মৃত্যু হলে তাকে সেখানেই দাহ করা হয়। মেজকুমার বলে পরিচয় দানকারী একজন প্রতারক, তাকে কেউ খাজনা দিবেন না। কয়েকদিন বাদে তা মির্জাপুর হাটে ঢোলসহরৎ প্রচার করতে গেলে প্রজাগণ ক্ষেপে গিয়ে আক্রমণ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গুলি চালালে একজন প্রজার মৃত্যুও হয়। প্রজাগণ খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়।

সরকার বাহাদুর ভাবনায় পড়ে গেল -কিভাবে এই সন্ন্যাসীকে প্রতারক প্রমাণ করা যায়! এদিকে প্রভাবতী এসে প্রজাদের বোঝানোর চেষ্ট করলেন যে, ইনি মেজকুমার নন। অথচ তিনি একবারের জন্যও সন্ন্যাসীকে দেখলেন না। এই পরিস্থিতিতে সন্ন্যাসী  ১৯৩০ সালের ২৪ শে এপ্রিল কোর্টে আত্মপরিচয় ও নিজ অধিকার আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করেন। বিচারক পান্নালাল বসুর আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয় ৩০ নভেম্বর। বাদী পক্ষের অন্যতম সাক্ষী কলকাতার চিকিৎসক প্রাণকৃষ্ণ আচার্য (ঘটনার সময় দার্জিলিং ছিলেন) জানান, মেজকুমারের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে ঢেকে রাখা কাপড় তুলে পরীক্ষা করতে গেলেই পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি বাহ্মণ, মৃত দেহ স্পর্শ করার অধিকার তার নেই। প্রতিপক্ষের অন্যতম ব্যক্তি সত্যেন্দ্রনাথ বাবু দার্জিলিং সিভিল সার্জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মেজকুমারের মৃত্যুর সনদ আদালতে দাখিল করেন। এ ছাড়াও দার্জিলিং আবহাওয়া অফিস থেকে সংগ্রহ করা সেই দিনের আবহাওয়ার প্রতিবেদন দাখিল করেন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন মৃত্যুর দিনে আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিল। তদন্তে অবশ্য আবহাওয়া অফিসে রক্ষিত তথ্যপত্রে কাটাছেড়া পাওয়া যায়। পরিবারের প্রায় সকল সদস্য আগেই মেনে নিয়েছিল যে, সন্ন্যাসীই মেজকুমার। ঠাকুর মা রাণী সত্যভামা দেবী তো ১৯২২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেজকুমারের সঙ্গেই ঢাকায় বসবাস করতেন।

মামলার শুনানির দিনগুলোতে আদালত প্রাঙ্গনে থাকত হাজারও মানুষের সমাগম। মামলার এক পর্যায়ে কোর্টের সামনে সন্ন্যাসী তার নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন, দার্জিলিং যাওয়ার পর চিকিৎসায় তার শরীর ভালই ছিল। তারপর এক রাতে হঠাৎ পেট ফাঁপা থেকে অসুস্থ্যতা শুরু হয়। সেই রাতেই আশুতোষ ডাক্তারের (১৯০৯ সালে দার্জিলিং যাওয়ার সময় মেজকুমারের সফরসঙ্গীদের অন্তর্গত পারিবারিক চিকিৎসক) সঙ্গে কথা হয়। পরের দিন এক ইংরেজ ডাক্তার আসেন এবং ওষুধ খেতে দেন। তিন দিন পর একই ওষুধ খান কিন্তু কোন লাভ হয় না। এবার আশুতোষ তাকে গ্লাসে করে ওষুধ দেন, তা খেয়েই বুক জ্বালা শুরু হয়ে যায়। তারপর বমি এবং শরীর ভীষণ অস্থির হয়ে যায়। পরের দিন রক্ত পায়খানা শুরু হলে কোন এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে দেখতে পান তিনি একটি চালার নিচে শোওয়া এবং চারজন সন্ন্যাসী তাকে ঘিরে রয়েছে। তারা জানায় সে চার দিন যাবৎ অচেতন রয়েছে। এরপর থেকেই তার সন্ন্যাস জীবন শুরু। গেলেন কাশ্মিরের অমরনাথ, সেখানেই দেখা হয় গুরু ধর্মদাসের সাথে। গুরুকে বলেন তার অতীত জীবনের কথা কিছু কিছু মনে পড়ছে। গুরু ধৈর্য ধরতে বলে আশ্বস্ত করেন, ঠিক সময়েই সে বাড়ি ফিরে যাবে।

জ্ঞান হারানোর পর যা ঘটেছিল তা অবশ্য মেজকুমারের জানার কথা নয়। কথিত মৃত্যুর পরের দিন সৎকারের জন্য তার মৃতদেহ দার্জিলিং শ্মশানে নেওয়ার পর শুরু হয় প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি। ঝড়ের মাত্রা এতটাই প্রবল ছিল যে, অন্যরা লাশ ফেলে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও দেশে ফিরে তারা প্রচার করেছিল সৎকার ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বিচার কার্যের শুনানি,সাক্ষ্য-প্রমাণ ইত্যাদি চলতে থাকে। বিবাদী পক্ষ অর্থাৎ সরকারী  আমলাগণ তো ধরেই নিয়েছিলেন যে, সন্ন্যাসী একটা ভন্ড প্রতারক। ঘটনা বহুল এই মামলার সাক্ষী হিসেবে নাগাসন্ন্যাসীদেরকে পর্যন্ত আনা হয়। বড়রাণী সূর্যবালা কলকাতায় অবস্থান করার কারণে তার সাক্ষ্য সেখানেই নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আর এক অন্যতম সাক্ষী পর্দানশীল জ্যোতির্ময়ীর খাতিরে তিন সপ্তাহ আদালত তার বাড়িতেই বসে। এমনকি বিশেষ সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য বিলেতে (লন্ডন) পর্যন্ত কমিশন বসে।

দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট। পান্নালালের আদালতের সামনে লোক যেন ভেঙ্গে পড়ছে। আগের রাত থেকেই বহু লোক দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতার পত্রিকাগুলিও চলে এসেছে। আনন্দবাজার পত্রিকা আর বসুমতি তাদের প্রতিবেদকদের জানিয়ে রেখেছে, রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করে জানাতে। দুটি পত্রিকাই এ উপলক্ষে তাদের বিশেষ সান্ধ্য সংস্করণ প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়।

ঘোষিত হলো বিচারক পান্নালাল বসুর ঐতিহাসিক রায়। ৫২৫ পাতা রায়ের মূল বক্তব্য- বাদী রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ রায়-ই ভাওয়াল রাজা। রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে বিবাদী পক্ষ কলকাতায় উচ্চ আদালতে আপিল করলেন। তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চে শুনানি চলে ১৬৪ দিন ধরে। শুনানি চলার সময়গুলিতে বিভাবতী ও তার ভাইয়ের পরিবারের বিরুদ্ধে স্থানীয় পত্র পত্রিকাগুলো প্রবল আক্রমণ করে। ১৯৪১ সালের মে মাসে উচ্চ আদালত নি¤œ আদালতের রায়ই বহাল রাখেন।

উচ্চ আদালতের রায়ে সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সে বছরই মারা যান। এবার বাকি থাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ আদালত প্রিভিকাউন্সিল। প্রিভিকাউন্সিলে আপিলের ব্যাপারে রাণী বিভাবতী উন্মুখ ছিলেন কিন্তু বোর্ড অব রেভিনিউ এর খুব একটা উৎসাহ ছিল না। আপিল গ্রহণযোগ্যতা পেলে সুদূর বিলেতে ২৮ দিন ধরে চলে শুনানি। শেষ ভরসার স্থলেও আপিলকারীর পরাজয় ঘটল। ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই মেজকুমার রমেন্দ্র্রনারায়ণের পক্ষে রায় ঘোষিত হয়। প্রিভিকাউন্সিলের লর্ড থ্যাংকারটনের মতে, এ রকম অসাধারণ, জটিল ও বিশালাকার মামলা সহজে দেখা যায় না।

রায় ঘোষণার পরের দিন ৩১ জুলাই সংবাদ পৌঁছে কোলকাতায়। কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ শেষ পর্যন্ত নিজ পরিচয় প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন। সংবাদটি শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। অভিনন্দন জানাতে তার ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে তখন শত শত লোকের ভিড়। কুমার যাচ্ছিলেন কর্ণাওয়ালিস স্ট্রিটের ঠনঠনিয়া কালীমন্দিরে পূজা দিতে। রাস্তায় বেরোতেই তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। তার শরীর কিছু দিন ধরেই ভালো যাচ্ছিল না। পরের দিন ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে’ তার ছোট্ট মৃত্যু সংবাদ ছাপা হল। সংবাদের মূল কথা ছিল, আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি প্রাপ্তির মাত্র এক দিন পর ১ আগস্ট, ১৯৪৬ সালে রাজপুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী সব মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন চিরতরে।

ঢাকা জার্নাল, ডিসেম্বর ১৯,২০১৫।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.