জামায়াত নিষিদ্ধ চায় বিএনপিও

নভেম্বর ২৬, ২০১৫

12নিজেদের জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে সরকারকে ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছে বিএনপি। দলটির একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করে  জানিয়েছে, ভারতের সংশ্লিষ্ট ‘কর্তৃপক্ষ’ ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপি এই সম্মতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। মূলত ভারতকে ‘খুশি করতেই’ বিএনপির এই ত্যাগ স্বীকার। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের নানা মহল থেকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের চাপ সইতে হচ্ছে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলটিকে। আর এখন যেহেতু সরকার নিজে থেকেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটছে, তাই সে সুযোগটি কাজে লাগাতেই সবুজ সংকেত দিয়ে রাখছে বিএনপি।

জামায়াতকে নিয়ে চাপের মধ্যে থাকা বিএনপি নেতারা বলছেন, ঠেলে জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দিলে তাতে এত দিনের প্রধান রাজনৈতিক মিত্র দলটি ক্ষুব্ধ হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার চেয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই কৌশলগতভাবে তাঁদের জন্য সুবিধা হয়। কারণ নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতের ভোট বিএনপির পক্ষে যাবে বলেই তাঁদের ধারণা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান স্বীকার করেন, জামায়াত প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আছে। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে, তাহলে তো কোনো ঝামেলা থাকে না। কিন্তু তারা তো এ নিয়ে রাজনীতি করছে বলে মনে হয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির প্রভাবশালী একজন ভাইস চেয়ারম্যান  বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা ভারতকে বলেছি, তোমরা সরকারকে বলো, তারা যেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। আমরা তো প্রকাশ্যে আপত্তি করছি না।’ কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে জোট ভেঙে দেওয়া কৌশলগত কারণে বিএনপির জন্য কিছুটা কঠিন, এ কথা নানাভাবে ভারতীয়দের বোঝানো হয়েছে, যোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা এই নেতা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত  বলেন, ‘বিএনপি কোনো সবুজ সংকেত দিয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। বিএনপি এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে।’

ওদিকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণের দিক থেকেও জামায়াতকে নিয়ে প্রচণ্ড চাপে আছে বিএনপি। সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও পশ্চিমা বিশ্ব দলটির রাজনীতিকে আর সেভাবে গ্রহণ করছে না। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিসহ নানা ক্ষেত্রেও কৌশলগতভাবে বিএনপি চাপে রয়েছে। সব মিলিয়ে কী উপায়ে তারা জামায়াতকে বের করবে, অনেক দিন ধরে সেই কৌশলই খুঁজছে।

সূত্র মতে, এ প্রশ্নে বিএনপির একটি অংশের মত ছিল, জোটের পরিধি ছোট করে এবং ছোট ছোট দলগুলোকে বিএনপিতে একীভূত করে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া, যাতে করে জামায়াত এমনিতেই জোট থেকে চলে যায়। কারণ জামায়াত কখনোই বিএনপির সঙ্গে একীভূত হতে চাইবে না।

আরেক অংশের মত হচ্ছে, বৈশ্বিক রাজনীতি ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামায়াতকে বলে-কয়ে জোট ছাড়ার ব্যাপারে রাজি করানো। উদ্দেশ্য হলো, ভুল বোঝাবুঝি না করে জামায়াত যাতে নিজেরাই জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। সূত্র মতে, এ ধারার নেতাদের যুক্তি হলো, আগে নির্বাচন হোক। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আর যা-ই হোক, জামায়াতের ওপর অত্যাচার কমবে।

জানতে চাইলে শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ   বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করুক না! তারা বিএনপিকে টানাটানি করছে কেন? তা ছাড়া জোট ভাঙার এই ঝুঁকি বা দায় বিএনপি কেন নেবে?’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জামায়াত প্রশ্নে ভারতের চাপ আছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু চরমপন্থা বা মৌলবাদ প্রশ্নে ওদের দেশের অবস্থা তো আরো খারাপ। সেখানে আরএসএস বলছে, ওই দেশ হিন্দুদের। কিন্তু জামায়াত তো এ কথা কখনো বলেনি যে বাংলাদেশ কেবল মুসলমানদের দেশ!’

এদিকে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে ও মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েও বিষয়টি নিয়ে তাঁদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর তাঁরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে কিছু দিন আগে দলটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমির হামিদুর রহমান আযাদ এ প্রসঙ্গে জানান, ভারতীয়রা জামায়াতের সঙ্গে কথা বলে না, এমন নয়। তাঁর দাবি, আলোচনায় আবার বিএনপির ব্যাপারে ভারত অনেক নেতিবাচক কথাও বলে। ফলে জোট ভাঙলেই যে সমস্যা সমাধান হবে, এমন নয়।

সূত্র মতে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াতকে বাইরে রাখার জন্য কয়েক বছর ধরেই বিএনপি ভারতের চাপের মধ্যে আছে বলে দলটির মধ্যে আলোচনা আছে। প্রায় ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় সাম্প্রতিককালে ভারতের এই চাপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা দলটির প্রায় সর্বস্তরে এখন খোলাসা হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, শুধু ভারতের সমর্থনের কারণে সরকার টিকে আছে। পাশাপাশি বিএনপিকে চাপে ফেলার জন্য সরকারও এক ধরনের রাজনীতি করছে বলে অভিযোগ তুলছে দলটি।

শুধু তাই নয়, ভারতের সম্মতি পাওয়ার জন্য ‘জামায়াতকে ছাড়তে হবে’-এটি দেশটির তরফ থেকে এক ধরনের শর্ত বলেই বিএনপি ধরে নিয়েছে। কারণ দেশটি তাদের নিরাপত্তার জন্য জামায়াতকে হুমকি বলে মনে করে। ফলে কয়েক বছর ধরেই পর্দার আড়ালে অন্য অনেক ইস্যুর সঙ্গে এ ইস্যুও বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় সামনে এনেছে ভারত। আর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের একের পর এক ফাঁসি হওয়ার ঘটনায় সাম্প্রতিককালে জামায়াত প্রশ্নে বিএনপির ওপর চাপ তারা আরো বাড়িয়েছে। ফলে বিএনপির উপলব্ধি হলো, ভারতকে খুশি না করে ক্ষমতায় আসা যাবে না। অর্থাৎ ভারত চাপ না দিলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আদায় করা যাবে না। তাই আগে সময়ক্ষেপণ করলেও গত বছর ৫ জানুয়ারির পর দলটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মরিয়া হয়ে ওঠে। কারণ তারা মনে করে, শুধু ভারতের সমর্থনের কারণেই ৫ জানুয়ারি যেনতন হলেও একটি নির্বাচন করতে সরকার সক্ষম হয়েছে। ফলে দেশটিকে সন্তুষ্ট করতে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বিএনপি নেতারা যে যেখান থেকে পারেন, ভারতের ক্ষমতার বিভিন্ন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত এসব আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে, পর্দার আড়ালে এবং কূটনৈতিক পর্যায়ের পাশাপাশি বিএনপি ও ভারতের ‘ক্ষমতার বিকল্প বিভিন্ন কেন্দ্রে’র মধ্যে। এ ছাড়া দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপির একটি অংশের সঙ্গেও বিএনপি নেতাদের যোগাযোগের কথা জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, অনানুষ্ঠানিক এসব আলোচনায় প্রধান ইস্যু হচ্ছে ভারতের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিষয়টি। বিএনপি এ প্রশ্নে ভারতের প্রায় সব শর্তেই রাজি বলে জানা যায়। শুরুর দিকে বিএনপি অবশ্য ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জামায়াতের সঙ্গেই আলোচনা করার পরামর্শ দেয়। তাদের যুক্তি ছিল, তারা আলোচনা করুক; কোনো ইস্যু নিয়ে সমস্যা হলে সেটি বিএনপি নিষ্পত্তি করবে। কিন্তু এ ধরনের কৌশলে ভারত রাজি হয়নি। তারা বিএনপি-জামায়াতের জোট না থাকার ওপরই জোর দিয়েছে।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.