যুক্তরাজ্যের পর যুক্তরাষ্ট্রেও মুসলমানদের উপর ধর্মীয় সহিংসতা বেড়েছে

নভেম্বর ২৩, ২০১৫

32 নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইউরোপে মুসলমানদের উপর সহিংসতা বেড়েই চলেছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কার্যক্রম শুরুর পর থেকে যুক্তরাজ্যে মুসলমানদের উপর ধর্মীয় সহিংসতা আগের তুলনায় বেড়েছে। এছাড়া সম্প্রতি প্যারিস হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রেও মুসলমানদের উপর ‘ঘৃণাসূচক’ আক্রমণ, মসজিদে হামলা এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপর হুমকি বেড়েছে।

সম্প্রতি ফ্রান্সের প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মুসলিমদের ওপর বর্ণবাদী আক্রমণের হার ৩০০ ভাগেরও বেশি বেড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির একটি সরকারি সংস্থা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা এ ধরনের হামলার শিকার হচ্ছেন বলে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক খবরে প্রকাশ করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে মুসলিম ও মসজিদে হামলার ঘটনা রেকর্ডে রাখা টেলম্যামা হেল্পলাইনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৩ নভেম্বর প্যারিস হামলার পর যুক্তরাজ্যজুড়ে মুসলিমদের ওপর আক্রমণের হার ৩০০ ভাগেও বেশি বেড়ে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী পোশাক পরা ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীরা বেশি হামলার শিকার হচ্ছেন। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ পুরুষরাই মূলত: এ সকল আক্রমণ পরিচালনা করে থাকে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পাবলিক প্লেস, বাস ও ট্রেনে বেশিরভাগ হামলার ঘটনা ঘটছে। মুসলিম মেয়েশিশুরাও এ হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেককেই প্রতিনিয়ত নানা কটূক্তির শিকার হতে হচ্ছে।

ইসলামিক হিউম্যান রাইটস কমিশন নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ৫৬ শতাংশ মুসলিম কোনো না কোনোভাবে মানসিক এবং শারীরীক হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

সংগঠনটি বলছে, বৃটিশ সরকারের বিভিন্ন নীতিই বৃটেনে ইসলামোফোবিয়া (মুসলিম বিদ্বেষ) বৃদ্ধিতে মূল জ্বালানি জোগাচ্ছে। ধর্মীয় হামলার শিকার হওয়াটা বৃটিশ মুসলিমদের জন্য নিত্যদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

সংগঠনটি ১ হাজার ৭৮২ জনের উপর একটি জরিপ চালিয়ে মুসলমানদের উপর ধর্মীয় হামলা বৃদ্ধির স্পষ্ট চিত্র দেখতে পায়। বিশেষ করে ব্রিটিশ সরকারের নিরাপত্তা আর চরমপন্থা সংশ্লিষ্ট নীতিগুলো সেদেশের মুসলিমদের উপর ‘নেতিবাচক প্রভাব’ ফেলছে বলে জানিয়েছে জরিপে অংশ নেওয়া লোকজন।

জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি মানুষই বলেছেন, তাদেরকে ভুলভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে কিংবা তাদের উপর অযাচিত সন্দেহ করা হচ্ছে।

৬০ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করে, রাজনীতিবিদরা তাদের বিষয়ে কিছুই ভাবেনা। ৫৬ শতাংশ মানুষ কটু মন্তব্যের শিকার হয়েছেন আর ১৮ শতাংশ মুসলিমকে শারীরিক আঘাত করা হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর বলছে, মুসলিম বিদ্বেষ বন্ধে তারা সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে ঈমান নামের উনিশ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ ধর্মান্তরিত মুসলিম তরুণীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।ঈমান জানিয়েছে, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তার কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে যে, সে উগ্রপন্থী হয়ে উঠেছে। তারা সন্ত্রাসবিরোধী কর্তৃপক্ষের কাছেও তার বিষয়ে রিপোর্ট করে। পরে কর্মকর্তারা ধর্মাচরণ আর বিশ্বাস নিয়ে তার সঙ্গে কথাও বলেন।

যখন তারা নিশ্চিত হয় যে, সে কোনো উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়, তখন তারা তাকে ব্যবহারেরও চেষ্টা করে।

ঈমান বলছেন, এখন পরিস্থিতি এমন যে, একজন মুসলিম হিসেবে অন্যদের মতো আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন করার অধিকার নেই। আমাকে হয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, না হলে নিজেই উগ্রপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে।

গ্যাটে ইমেজ

গবেষক আরজু মিরালি বলছেন, এখন এখানে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে মুসলিমরা মনে করেন, তাদের সবসময় সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে এবং তাদের জীবনযাপন দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে।

বৃটেনে ইসলামোফোবিয়ার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে অক্টোবর মাসে। লন্ডনে বাসে একজন মুসলিম নারীর উপর অপর এক বৃটিশ যাত্রীর বর্নবাদী মন্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এর তদন্ত শুরু করেছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, মুসলিম নারীকে আইএস সম্মোধন করে ওই যাত্রী বলছেন, ‘তোমরা তোমাদের দেশে চলে যাও।’এক পর্যায়ে ওই নারীকে লাথি মারারও হুমকি দেন তিনি। মুসলিম ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাকে বৃটিশ নারীযাত্রীটি বলতে থাকেন ‘তোমার পেটে লাথি মারব। যেন তোমার কখনো সন্তান না হতে পারে।’ ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করেন অন্য আরেক যাত্রী। পরে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

প্যারিসে ভয়াবহ হামলা শুধু ফ্রান্স নয়, পুরো ইউরোপেই কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।  এতো শক্তিশালী গোয়েন্দা নজরদারি ও সুরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা ভেঙে কীভাবে প্যারিসে এত ভয়াবহ হামলা হতে পারে তা ভাবাচ্ছে ইউরোপের নেতাদের। ফ্রান্সের ইতিহাসের ভয়াবহতম এ হামলায় ১৩২ জন নিহত হয়েছেন। আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করার পর ফ্রান্স, ইউরোপ ও বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়া নতুন করে মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। ফরাসি মুসলিমরা জানিয়েছেন প্যারিস হামলার পর তারা নতুন করে আতঙ্ক আর উত্তেজনায় ভুগছেন।

প্যারিস হামলার অন্যতম অভিযুক্ত ওমর ইসমাইল মোস্তাফির কয়েকজন প্রতিবেশী বলেছেন, ও আমাদের এখানেই থাকত, অথচ জানতাম না যে এতোবড় সন্ত্রাসী। এ ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের এখানেও ঘটতে পারতো।

প্যারিস হামলায় নিহতদের প্রতি শোক জানাচ্ছেন ফরাসি মুসলিম নারীরা। ছবি: আল জাজিরা

ফরাসি নারী সায়মা বলেন, আইএস যেটা করছে সেটা সম্পূর্ণ ভুল। সেটা কখনোই ইসলাম হতে পারে না। নিজের নামের শেষ অংশ প্রকাশ করতে চাইলেন না সায়মা। কারণ, তার মুসলিম নাম প্রকাশ হয়ে গেলে তার কমিউনিটিতে তিনি হুমকির মধ্যে পড়বেন।

ফ্রান্সে সম্প্রতি ইসলামবিরোধী মনোভাবের ব্যাপক উত্থান হয়েছে। প্যারিস হামলার পর সেটি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানাচ্ছেন সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী।

এদিকে প্যারিসের ঘটনার প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের উপরও। আমেরিকায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে দ্য কাউন্সিল অন আমেরিকান রিলেশন (সিএআইআর) গত মঙ্গলবার বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভাঙ্গচুরের একটি তালিকা তৈরী করেছে। দেশটির মাসাচুস্টেস, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, কেন্টাকী, ভার্জিনিয়া, নেব্রাস্কা, টেনেসি, ওয়াইও, নিউইয়র্কসহ অনেক রাজ্যে ঘৃণাসূচক আক্রমনের স্বীকার হচ্ছেন মুসলিমরা। ২৭টি অঙ্গরাজ্যের ২৬জন রিপাবলিকান দলের ডানহাত এবং একজন ডেমোক্রেট দলের সিনেটর বলেছেন, প্যারিসে হামলা এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় স্বীকারের প্রেক্ষাপটে মার্কিন সাম্রাজ্যে সিরীয় শরর্ণাথী ঢুকতে দেওয়া হবে না।

এরই ধারাবাহিকতায় সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ে প্রত্যেককে ‘এফবিআই’ ও ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স’ এর পরিচালক এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রীর ছাড়পত্রের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে শুক্রবার নতুন বিল পাশ করেছে মার্কিন কংগ্রেস। এখন থেকে পূর্বানুমোতি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী প্রবেশে করতে পারবে না। আগামী ১ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে কার্যকর হবে এ সিদ্ধান্ত। মার্কিন কংগ্রেসে ২৮৯-১৩৭ ভোটে পরাজিত হয়েছে ১০ হাজার সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীর ভাগ্য।

সম্প্রতি একটি ঘটনায় নেব্রাস্কার ওমাহার ইসলামিক সেন্টারের এক কর্মকর্তা বলেন, মসজিদের একটি দেওয়ালে আইফেল টাওয়ারের ছবি পেইন্টিং করে দেওয়া হয়েছে। প্যারিস হামলার পর পরই ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবাগের ইসলামিক সেন্টারে বিভিন্নজন হুমকি দিতে থাকেন।

গত সোমবার সকালে টেক্সাসের ফ্লুগেরভিল শহরের এক মসজিদে প্রবেশ করে বিভিন্ন জিনিসপত্র তছনস করেছে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা। এমনকি তাদের রোষ থেকে রেহাই পায়নি মুসলিমদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন শরিফ। ওইদিন সকালে মসজিদের প্রবেশের পর মুসল্লিরা দেখেন, বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কুরআনের ছেড়া পাতা। মসজিদের এখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে মল।

প্যারিস হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবার্গে কেয়ারের অফিসে হুমকি দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য মসজিদেও হুমকি দেয়া হচ্ছে। পোর্টল্যান্ডে এক মসজিদের বাইরে নামাজ পড়তে আসা মুল্লিদের নানা ভাষায় গালিগালাজ করা হয়।

সূত্র: বিবিসি ও এক্সপ্রেস.সিও.ইউকে ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.