বচ্চনের গলাতেও অসহিষ্ণুতা বিরোধী সুর
অসহিষ্ণুতা’ শব্দটা সরাসরি উচ্চারণ করেননি তিনি। কিন্তু অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশ জোড়া বিতর্কের আবহে তাঁর কথাগুলো যেন মোদী জমানার নানা ঘটনাকেই বিদ্ধ করল। বাংলা চলচ্চিত্রে ধারাবাহিক ভাবে উদার এবং সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী বার্তার কথা বলতে গিয়ে এ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও কার্যত উদ্বেগ প্রকাশ করলেন তিনি। শনি-সন্ধ্যায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী আসরে অমিতাভ বচ্চন বললেন, ‘‘এ দেশের বহুত্ব, সংস্কৃতি নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। গোঁড়া ধ্যানধারণা দুনিয়াকে খানখান করে দিচ্ছে।’’ এই পটভূমিতে বাংলা ছবির ঐতিহ্য এক ধরনের রক্ষাকবচ বলে দাবি করলেন অমিতাভ। তাঁর মতে বাংলা ছবি বরাবরই শিখিয়েছে, ‘‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যই মানবতা।’’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর অমিতাভ। স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি-বিরোধী শিবিরের কাছে অমিতাভের বক্তব্য এ দিন অন্য তাৎপর্য বহন করেছে। তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক অতীতে দাদরি-কাণ্ড, হরিয়ানায় দলিত শিশু খুন, উদারমনা লেখকদের খুনের মতো ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ায় মোদী সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজে লন্ডনে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। দেশে বহু বিশিষ্ট জন সরকারি পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বলিউডে শাহরুখ খানের মতো তারকা ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শাসক দলের তোপের মুখে পড়েছেন। এ দিন কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে অমিতাভের বক্তব্য সেই প্রতিবাদী স্বরকেই জোরালো করল বলে মনে করা হচ্ছে।
পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। ‘অমিতজি’র পরে বলতে উঠে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কথা লুফে নিয়ে বললেন, ‘‘আমরাও এ দেশের বহুত্বে বিশ্বাস করি। অসহিষ্ণুতা মেনে নেব না।’’ উপরন্তু তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘অমিতজি শুধু এক জন ফিল্মি চরিত্র নন। তাঁর স্বচ্ছ ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় নেই।’’
বিদ্যা বালনের ফোন নিয়ে ‘গ্রুপফি’ তুলছেন অমিতাভ বচ্চন। সঙ্গে বিদ্যা এবং মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়া বচ্চন, শর্মিলা ঠাকুর ও সন্ধ্যা রায়। শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে, ফিল্মোৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে। ছবি: প্রদীপ আদক।
ভারতের সংস্কৃতি ও মননে বাংলা ছবির অবদান নিয়ে আলোচনা অমিতাভের প্রিয় বিষয়। এর আগেও কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ থেকে তিনি এই নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু এ বারে তিনি নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বেছে নিলেন বাংলা ছবিতে উদারতার প্রসঙ্গটি। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কথাগুলো বর্তমান সময়ের নিরিখে অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। নিউ থিয়েটার্সের যুগ থেকে শুরু করে বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বা গুরু দত্তের বিভিন্ন ছবিতে বাঙালি লেখকদের প্রভাব ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন অমিতাভ। বললেন, ‘‘এ দেশ বরাবরই বৈচিত্র্যময় সমাজে বিশ্বাস রেখেছে। বাংলা ছবি বিশেষ করে মেধাগত সংহতি (ইন্টেলেকচুয়াল ইন্টিগ্রিটি) ও খোলা মনের কথা বলেছে। ভারতীয় ছবিতে এই বোধটাই এসেছে বাঙালি চরিত্রের হাত ধরে।’’ এর পরেই দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বহুত্ব ও সংস্কৃতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে বলে মন্তব্য করেন অমিতাভ।
বাংলার সাংস্কৃতিক অবদানের প্রসঙ্গেই বিগ বি-র ব্যারিটোনে এ দিন ‘সার্থক জনম আমার’ এবং ‘জনগণমন অধিনায়ক’-এর একটি স্তবক, ‘ঘোর তিমিরঘন নিবিড় নিশীথে…’ শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের দর্শকের। মমতার ‘প্রিয় ভাই’ তথা বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খান এ দিন ছিলেন না ঠিকই। তবে একটু-আধটু মিষ্টি বাংলায় বিদ্যা বালন বা প্রবাসী জয়া বচ্চনরা বক্তৃতা জমিয়ে দিয়েছেন। পরে শর্মিলা ঠাকুর বলেন, মুষ্টিমেয়র ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে মমতা চলচ্চিত্র উৎসবের ভোল পাল্টে দিয়েছেন। প্রসেনজিৎ বা টলিউডি তারকাদের গ্ল্যামারের ভাগেও কম পড়েনি। বিক্রম ঘোষ, রাশিদ খান, তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, জর্জ ব্রুকস, তৌফিক কুরেশি, শিঞ্জিনি কুলকার্নিরা নাচ-গান-বাজনার একটি কোলাজে বাংলার সঙ্গে বিশ্বের সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের কথা তুলে ধরেন। এ বারের উৎসবের বিজ্ঞাপনেও বিভিন্ন হলিউডি প্রযোজক সংস্থার লোগোর মাঝে সুন্দরবনের বাঘ, হাওড়া ব্রিজ বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সঞ্চালক ‘ফেলুদা’ সব্যসাচী চক্রবর্তী ও ‘ব্যোমকেশ’ যিশু সেনগুপ্তরা বারবার বললেন, মমতার নেতৃত্বে চলচ্চিত্র উৎসব এখন অনেকটাই সর্বজনীন। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্যারিসে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয় এ দিন।