তেভাগা ও শোষণমুক্তির আন্দোলনের এক লড়াকু বিপ্লবী- ইলা মিত্র

অক্টোবর ১৩, ২০১৫

05রাজশাহী আদালতে ইলা মিত্র ইংরেজিতে লিখিত যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা থেকে তাঁর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে সে বিষয়ে জানা যায়। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘বিগত ০৭.০১.৫০ তারিখে আমি রোহনপুর থেকে গ্রেপ্তার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল থানা হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু পথে পাহারাদার পুলিশরা আমার ওপর অত্যাচার করে। নাচোলে ওরা আমাকে একটা সেলের মধ্যে রাখে। সেখানে একজন পুলিশের দারোগা আমাকে এ মর্মে ভীতি প্রদর্শন করে যে, আমি যদি হত্যাকান্ড সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি না করি, তাহলে ওরা আমাকে উলঙ্গ করবে। আমার যেহেতু বলার মত কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার পরনের সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় সেলের মধ্যে আটকে রাখে। আমাকে কোন খাবার দেওয়া হয়নি। এমন কি এক বিন্দু জলও না। ঐ সন্ধ্যায় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এসআইএর উপস্থিতিতে সিপাইরা এসে বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর ওরা আমার পরনের কাপড় চোপড় ফেরত দেয়। রাত প্রায় বারোটার সময় আমাকে বের করে সম্ভবত এসআইএর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি নিশ্চিত ছিলাম না। আমাকে যে কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে আমার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ওরা নৃশংস ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে ওরা আমার পা দুটোকে লাঠির মধ্যে রেখে ক্রমাগতভাবে চাপ দিতে শুরু করে। ওদের ভাষায় আমার বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানী ইনজেকশন’ পন্থায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল। এ ধরনের অত্যাচার চলার সময় ওরা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে রেখেছিল এবং আমার চুল ধরেও টান দিচ্ছিল। কিন্তু আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক কিছুই বলাতে সক্ষম হয়নি। এতসব অত্যাচারের দরুণ আমার পক্ষে আর হেঁটে যওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে নিয়ে গেল। এবার পুলিশের সেই দারোগা সিপাহীদের ৪টা গরম ডিম আনার নির্দেশ দিয়ে বলল যে, এবার মেয়েটাকে কথা বলতেই হবে। তারপর শুরু হল নতুন ধরনের অত্যাচার। ৪/৫ জন সিপাহী মিলে জোর করে আমাকে চিত্‍ হয়ে শুতে বাধ্য করল এবং ওদের একজন আমার গোপন অঙ্গ দিয়ে একটা ডিম ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। সে এক ভয়াবহ জ্বালা। প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করলাম, আমার ভিতরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে আমার জ্ঞান ফিরে এলো। একটু পরে জনাকয়েক পুলিশ সঙ্গে করে আবার সেই দারোগার আগমন ঘটে। সেলে ঢুকেই সে আমার তলপেটে বুট দিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি মারে। আমি দারুণ ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। এরপর ওরা জোর করে আমার ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছি। কোন রকম স্বীকারোক্তি না পেয়ে দারোগা তখন রাগে অগ্নিশর্মা। যাওয়ার আগে বলে গেল, আমরা আবার রাতে আসব। তখন তুমি স্বীকারোক্তি না দিলে, একের পর এক সিপাহী তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে দারোগা আর সিপাহীরা আবার এলো এবং আবারো হুমকি দিল স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। এবার দু জন মিলে আমাকে মেঝেতে ফেলে ধরে রাখল এবং একজন সেপাহী আমাকে রীতিমত ধর্ষর্ণ করতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম…।” (সূত্র: ড. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্থ, মুক্তিমঞ্চে নারী, প্রিপ ট্রাস্ট, ১৯৯৯, ঢাকা)।
ইলা মিত্রের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর। কলকাতায়। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় ইলা সেন। রমেন্দ্র মিত্রের সাথে বিবাহ হওয়ায় তাঁর নাম হয় ইলা মিত্র। এই নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন। তিনি ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীন বাংলার একাউন্টেন্ট জেনারেল। ইলা মিত্রের আদি বসতবাড়ি ছিল যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকুরির কারণে তারা কলকাতায় বসবাস করতেন। কলকাতা শহরেই ইলার কৈশোর শৈশব ও যৌবন অনেকটা সময় কাটে। লেখাপড়া হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর কলকাতার বেথুন স্কুল ও কলেজে। কলেজ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলায়ও তুখোড় ছিলেন। ১৯৩৫-৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন বেশ পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। যুদ্ধের জন্য অলিম্পিক বাতিল হয়ে যায়। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ১৯৩৬-৪২ সালের মধ্যে ইলা মিত্রের নাম সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
ইলা মিত্র বেথুন কলেজে পড়াশুনা করার সময়ে নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হন। হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে মহিলা সমিতি আন্দোলনে তিনি একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকাবস্থায় তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন।
১৯৪৫ সালে ইলা মিত্রের বিয়ে হয় বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্র মিত্রের সাথে। বিয়ের পর কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে। হিন্দু রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের নিয়মানুসারে অন্দরমহলেই থাকতেন ইলা মিত্র। এই সময় রমেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়া কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খুলেন। রমেন্দ্র মিত্রের কাছে গ্রামের সবাই দাবি জানালেন তাঁদের নিরক্ষর মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নিতে হবে বধুমাতা ইলা মিত্রকে। অনুমতি পেল ইলা মিত্র। মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হলো। তিনমাসের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০/৫০ জনে।
স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের কাছে তিনি জমিদার ও জোতদারের হাতে বাংলার চাষীদের নিদারুণ বঞ্চনা, শোষণ এবং শোষণের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলনের কাহিনী শোনেন। অনেক পূর্বে কমিউনিস্ট রমেন্দ্র মিত্র জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য ও মোহ ত্যাগ করে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িছেন। রমেন্দ্র মিত্র ইলা মিত্রকে এসব কাজে উত্‍সাহ দেন। ১৯৪৬-৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র।
কৃষক জমির মালিক নয়, তাই উত্‍পাদিত ফসলের অর্ধেক দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘আধিয়ারী’। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। চালাত নিপিড়ন, নির্যাতন। অনেক সময় খাজনা না দিলে কৃষকদের মেয়ে-বউ ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে মৃত্যুমুখে ছেড়ে দিত। খাজনা পরিশোধ করার জন্য কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হতো। যার ফলে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে পরিনত হয়।
এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। যার ফলে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় ‘সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় ‘ফাউন্ড কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উত্‍পাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চল্লিশের দশকে এসব আন্দোলনে ইলা মিত্র নেতৃত্ব দেন। ১৯৪২ সালে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। এ সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হতে থাকে তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় সংগঠিত হয় যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি চাষিদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। পার্টি থেকে রমেন্দ্র মিত্র ও ইলা মিত্রকে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে তেভাগা আন্দোলনকে জোরদার করতে বলা হয়। ১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করতে এগিয়ে আসে। এসময় ইলা মিত্র নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত গ্রাম হাসনাবাদে পুনর্বাসনের কাজে চলে যান।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর মিত্র পরিবারের জমিদারি অঞ্চল রামচন্দ্রপুর হাট পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান হবার পরও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন হয়। মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের এই আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করে। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। পার্টির শীর্ষ নেতারা আত্মগোপন করে কাজ করতে থাকেন। ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্র নাচোলের চণ্ডীপুর গ্রামে আত্মগোপন করেন। আত্মগোপন অবস্থায় তাঁরা চণ্ডীপুর গ্রামে এক শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯৪৮ সাল। ইলা মিত্র অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান প্রসবের জন্য তিনি গোপনে কলকাতায় যান। পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এক মাস বয়সের ছেলেকে শাশুড়ির কাছে রামচন্দ্রপুর হাটে রেখে তিনি আবার ফিরে আসেন নাচোলে। ১৯৪৯ সালে তাঁদের নেতৃত্বে হাজার হাজার ভূমিহীন কৃষক সংগঠিত হয়। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে জোতদার, মহাজনদের দল। ওই বছর কৃষকের ধান জোতদারদের না দিয়ে সরাসরি কৃষক সমিতির উঠোনে তোলা হয়। ফলে সংঘর্ষ বাধে। নাচোলে সাঁওতাল ও ভূমিহীনদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী তীরন্দাজ ও লাঠিয়াল বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন মাতলা মাঝি। এভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্র। নাচোল অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের বাস্তব রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন তারা। ১৯৫০ সালে জোতদার ও ভূমি মালিকেরা নাচোলের ভিতর এবং আশেপাশে তেভাগা কার্যকর করতে বাধ্য হল। সরকারের পুলিশ বাহিনী গ্রামে গ্রামে অভিযান চালিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ বাহিনী চণ্ডীপুর গ্রামে আসে। গ্রামবাসী সংগঠিত হয়ে পুলিশ বাহিনীকে পাল্টা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে উত্তেজিত গ্রামবাসী ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও পাঁচ জন পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করে। এই ঘটনার দু’দিন পর ৭ জানুয়ারি শুরু হলো পুলিশের প্রতিশোধ। দুই হাজার সেনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে উপস্থিত হয়ে অভিযান শুরু করে। বারোটি গ্রাম ঘেরাও করে তছনছ করে। ঘরবাড়ি ধ্বংস করে। গুলি চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য গ্রামবাসীকে। নারীদের ধর্ষণ করে। শিশুদের চালায় যৌন নির্যাতন। আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীরা যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যায়। ইলা মিত্র ৭ জানুয়ারি সাঁওতাল বেশ ধারণ করে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ভারত সীমানা পার হওয়ার সময় তিনিশ আরো অনেক নেতা-কর্মী রোহনপুর রেলওয়ে স্টেশনে ধরা পড়ে যান। তাঁদের ধরে আনা হয় নাচোল স্টেশনে। পুলিশ তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। এই অত্যাচারে ইলা মিত্রর সাথীদের মধ্যে আনুমানিক ৮০/৯০ জন মারা যায়।
কমরেড ইলা মিত্রের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হলো। পুলিশ অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁর স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। টানা চার দিন অত্যাচারের পর নাচোল স্টেশন থেকে ইলা মিত্রকে নবাবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে আনা হয়। সে সময় তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর। ইলা মিত্রের ওপর বাঁশকল, শরীরের নাজুক অংশে বুটের আঘাত, বিবস্ত্র করে প্রহার, অনাহারে রাখা, ধর্ষণ, ইত্যাদি ধরণের অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়।
এরপর ইলা মিত্র, রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝিকে প্রধান আসামী করে এবং শতাধিক সাঁওতাল কৃষকের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি রাজশাহী কোর্টে উঠে। এটাই কুখ্যাত ‘নাচোল হত্যা মামলা’।
নাচোল হত্যা মামলার কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকায় রাজশাহীর তত্‍কালীন দায়রা জজ প্রধান তিন আসামীকে দোষী প্রমাণ করে যাবজ্জীবন ও ১০৭ জন কৃষককে হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয়। ইলা মিত্রকে রাজশাহী জেলে পাঠায়। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করা হলে শাস্তির মেয়াদ ১০ বছর কমিয়ে দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে তাঁকে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়। কমরেড ইলা মিত্র ও তাঁর সহযোদ্ধারা তখন ছাত্র জনতার চোখে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। সাধারণ মানুষ তাঁকে ছেড়ে দেয়ার দাবি করে রাজপথে নেমে আসে। ১৯৫৪ সালে কমরেড ইলা মিত্রের চিকিত্‍সার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়। তত্‍কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ পুলিশী নির্যাতনের ভয়াবহতা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। ওই বছর যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হলে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.সকে ফজলুল হকের নির্দেশে ইলা মিত্রের ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। এই টিমের সুপারিশে বলা হয়, ‘ইলা মিত্র নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। মুখ্যমন্ত্রী এই সুপারিশের ভিত্তিতে নির্দেশ দেন, ‘চোল হত্যা মামলার অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত আসামী ইলা মিত্রকে বিদেশে চিকিত্‍সার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হলো’।
চিকিৎসা হলো। সুস্থ্য হয়ে উঠলেন তিনি। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। সুস্থ হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৮৯ সালে তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ইলা মিত্র পশ্চিম বঙ্গের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির জেলা ও প্রাদেশিক কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি চারবার মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৭-৭২ সালে বিধান সভায় কমিউনিস্ট ডেপুটি লিডার ছিলেন। ১৯৬২-০২ পর্যন্ত শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি পাঁচবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য নির্বাচিত হন। পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন আন্দোলনের জন্য তিনি ১৯৬২, ৭০, ৭১ ও ৭২ সালে কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। ইলা মিত্র ভারতের মহিলা ফেডারেশনের জাতীয় পরিষদ সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির সহ-সভানেত্রী এবং ভারত ও সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির সহ-সভানেত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁর ছিল বিশেষ আন্তরিকতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন।
২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি মারা যান।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.