কিডনি কেটে নিয়ে লাশ ফেলা হয় নদীতে

আগস্ট ৩০, ২০১৫
kindদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সহজ-সরল ও দরিদ্র লোকদের নানাভাবে টাকার প্রলোভনে ফেলে ঢাকায় আনা হয়। এরপর আগেই ঠিক করে রাখা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে অচেতন করে দেহ থেকে কিডনি কেটে নেওয়া হয়। পরে ওই অবস্থায় হত্যা করে লাশ বুড়িগঙ্গা বা অন্য কোনো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এই ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে শুক্রবার রাতে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা কিডনি পাচারকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে।
রক্ত দিলে বিনিময়ে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে মাহবুবুর রহমান শান্ত ও আবু হাসান নামের দুজনকে কৌশলে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল কিডনি পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই দুজনকে আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে তুলে দেওয়া। এরপর পরিকল্পনা ছিল কৌশলে তাঁদের কিডনি কেটে নিয়ে হত্যা করে লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অসাধু চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার এবং তাদের শিকার ওই দুজনকে উদ্ধার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এভাবে বেশ কয়েক বছর ধরে সারা দেশে কিডনি পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ সারা দেশের বিভাগীয় শহর ও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকাকেন্দ্রিক ৬৩টি কিডনি পাচারকারী চক্র সক্রিয়। দীর্ঘদিন ধরেই দেশীয় চক্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রের, যাদের ব্যবসাই কিডনি কেনাবেচা। তাদের মূল টার্গেট গ্রাম এলাকার সহজ-সরল ও দরিদ্র মানুষ। টাকার লোভে ফেলে ও নানা প্রলোভনে আকৃষ্ট করে কৌশলে তাদের কিডনি নিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা।
অনেক ক্ষেত্রে এরা ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক এই চক্রকে মাঠপর্যায়ে সহযোগিতা করছে বেশ কয়েকটি এনজিও, শীর্ষ পর্যায়ের বেসরকারি সংস্থা এবং গ্রাম্য সুদ ব্যবসায়ীরা। সহায়তা করছেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কিছু অসৎ চিকিৎসক আর ক্লিনিক ব্যবসায়ীও। খোদ ঢাকাতেই রয়েছে এ রকম অন্তত ১০টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। রয়েছে সংঘবদ্ধ পাঁচটি চক্র।

এর আগেও ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া জয়পুরহাটের একটি চক্রের নেতা তারেক ওরফে বাবুল, জয়পুরহাটে গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল, সাত্তার, মোস্তফা, ফোরকানসহ অন্তত ৩০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক টিম। এভাবে কিডনি পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে তাদের তথ্যের সূত্র ধরে এর আগেও পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক তদন্ত টিম কাজ করেছে।
তবে মাঠপর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় দু-একজন নেতাসহ তাদের সহযোগীরা গ্রেপ্তার হলেও নেপথ্যের গডফাদাররা আড়ালে থাকায় চক্রের সদস্যরা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছে। কয়েক বছর আগে জয়পুরহাটে কিডনি পাচারকারী একটি চক্রের সক্রিয়তার খবর প্রকাশ পেলে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। ওই সব ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে অর্ধশতাধিক কিডনি পাচারকারী চক্র রয়েছে। দেশি চক্রের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রের যোগাযোগ রয়েছে বলে গতকাল গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।
র‌্যাবের মিডিয়া উইং পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সারা দেশেই এ ধরনের চক্র সক্রিয়। এই চক্রের সদস্যদের ধরতে র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট তৎপর রয়েছে।
আবার গ্রেপ্তার পাঁচজন : গত শুক্রবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক কিডনি পাচাকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো সংঘবদ্ধ চক্রের দলনেতা আবদুল জলিল, তার সহযোগী শেখ জাকির ইবনে আজিজ ওরফে শাকির, আশিকুর রহমান জেবিন, ফজলে রাব্বি ও জিহান রহমান। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি চেতনানাশক ইনজেকশন, একটি ধারালো ছুরি, একটি সিরিঞ্জ ও একটি তোয়ালে উদ্ধার করা হয়। গতকাল দুপুর ১টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে গ্রেপ্তারকৃতদের হাজির করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত আবদুল জলিল ভারতেও কিডনি বিক্রি করেছে এমন তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। ভারতের কয়েকটি হাসপাতালে এসব কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। তাদের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের কিছু চিকিৎসকের যোগাযোগ রয়েছে। সে ও তার দলের সদস্যরা এ পর্যন্ত শতাধিক কিডনি কেনাবেচা করেছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পর্কে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, তারা আন্তর্জাতিক কিডনি পাচারকারী চক্রের সদস্য। তারা অনেক দিন ধরে কিডনি পাচার করছিল। রোগীদের টার্গেট করে তাদের কাছে এসব কিডনি বিক্রি করা হতো। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কলকাতার একটি হাসপাতালে গিয়ে এসব কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। তিনি বলেন, চক্রটি জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র ও সরল মানুষদের কাছ থেকে কিডনি ছিনিয়ে নিত।
মনিরুল ইসলাম গতকাল ব্রিফিংয়ে জানান, এই চক্র খুবই ভয়ংকর। যারা কিডনি দিতে অস্বীকার করে তাদের অজ্ঞান করে কিডনি নেওয়া হতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সদস্যরা বলেছে, গত ১০ বছরে চারটি কিডনি বিক্রি করেছে তারা। তাদের গ্রেপ্তার অভিযানের সময় প্রলোভনে পড়া জয়পুরহাটের আবু হাসান ও মুন্সীগঞ্জের মাহবুবুর রহমান শান্ত নামে দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে চক্রের সদস্যরা কিডনি নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। গ্রেপ্তারকৃতরা কিডনি অপসারণ করার সময় অনেককে হত্যা করে। এরপর মরদেহ বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীতে ফেলে দেয়।
ডিবির ব্রিফিংয়ে বলা হয়, কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের দালাল আবদুল জলিল জয়পুরহাট থেকে কিডনি বিক্রির জন্য আবু হাসান নামের এক যুবককে নিয়ে ঢাকায় আসার পথে গাবতলীতে গ্রেপ্তার হয়। পরে জলিলের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমির আশপাশের এলাকা থেকে মাহবুবুর রহমান শান্তকে উদ্ধার করে কিডনি পাচারকারী চক্রের আরো চারজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
আবু হাসান ও শান্ত গোয়েন্দা পুলিশকে বলেন, একটি কিডনির বিনিময়ে জলিল তাঁকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে  দেওয়ার কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসে।
তবে ডিবির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আশিকুর রহমান জেবিন বলে, সে দলনেতা আব্দুল জলিলের কথামতো ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে রক্ত দেওয়ার কথা বলে তার পূর্বপরিচিত মাহবুবুর রহমান শান্তকে গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
গ্রেপ্তারকৃত শেখ শাকির জানায়, দলনেতা জলিলের নির্দেশে সে চার লাখ টাকার বিনিময়ে তার অন্য সহযোগী আশিক, ফজলে রাব্বি ও জিহানকে সঙ্গে নিয়ে শান্ত ও আবু হাসানের কিডনি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করে তাঁদের কিডনি অপসারণ করার জন্য আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিডনি অপসারণের পর তাদের হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল।
ব্রিফিংয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, শান্ত ও আবু হাসানকে ঢাকায় এনে কিডনি অপসারণের পর তাদের হত্যা করে লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলতে ভিন্ন নামে লঞ্চের একটি সিট বুকিংয়ের কথা ছিল এই চক্রের। তাদের একটি করে কিডনি দেওয়ার বিনিময়ে দুজনকে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখায় তারা। আর চক্রের যে সদস্যদের মাধ্যমে কিডনি কেটে নেওয়া হবে, তাদের তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। তবে একটি কিডনি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকার বেশি কেউ পায় না।
যেভাবে জলিল দলনেতা : জলিল ডিবিকে জানায়, ২০১১ সালে সে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেছিল। তার অস্ত্রোপচার হয়েছিল ভারতে। এরপর সে নিজেও পাচারকারী চক্রে ভিড়ে যায়। একটি কিডনি জোগাড় করতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পায় সে। এর আগেও জয়পুরহাট থেকে দুজনকে ঢাকায় এনে কিডনি  নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে সে।
ডিবি সূত্র জানায়, রাজধানীর অদূরে সাভারের কয়েকটি ক্লিনিক ও হাসপাতাল সম্পর্কেও তাদের কাছে এ ধরনের খবর আছে। বিশেষ করে একটি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে, যেটির মালিক নিজেও একজন চিকিৎসক এবং তাঁর বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এই চিকিৎসক নানাভাবে বিতর্কিত এবং এর আগেও একাধিকবার সংবাদ শিরোনাম হয়ে এসেছেন। তাঁর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
সীমান্ত এলাকার মানুষের একটি বড় অংশই অতি দরিদ্র। তাদের মূল ব্যবসা চোরাচালানের পণ্য বহন করা। দুই দেশের পুলিশ, সীমান্তরক্ষীদের দিয়ে তাদের যা থাকে তাতে সংসার চালানো কঠিন। আবার মাঝেমধ্যে মালামাল ধরা পড়লে তারা আরো বিপদে পড়ে। তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় দাদন বা সুদ ব্যবসায়ী ও এনজিওগুলো ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় এবং টাকা ধার দেয়। এই টাকা পরিশোধ করতে না পেরে তারা পড়ে যায় চাপের মুখে। পরে তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয় কিডনি আর লিভার বিক্রির।
চক্র অনেক বড় : এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল কিডনি চক্রের সঙ্গে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ছয় এজেন্ট, ঢাকার নামকরা ছয়টি হাসপাতাল, ১৪ জন চিকিৎসক ও টিস্যু ম্যাচিং কাজে দুজন টেকনিশিয়ানের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
এর আগে গ্রেপ্তার বাবুল নামের কিডনি পাচারকারী চক্রের আরেক সদস্য সাংবাদিকদের জানায়, সে উচ্চশিক্ষিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও অর্থের লোভে এ ধরনের কাজে নামে। টানা ছয় বছর এই চক্রের সঙ্গে কাজ করে। সে অন্তত ৪০টি কিডনি বেচাকেনা করে। তাকে সহায়তা করেছে কয়েকটি এনজিওর কর্মীরা। ঢাকায়ও তাদের চক্র আছে। হাত করা আছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এই ব্যবসা শুরুর পর একপর্যায়ে ভালো আয় হওয়ার কারণে পেশা হিসেবেই এটাকে বেছে নেয়।
বাবুলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, বাবুল বেশ কয়েকটি এনজিও এবং সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের নাম বলেছে। হাসপাতাল বা ক্লিনিকের চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখা হচ্ছে।
ডিএমপির সহকারী কমিশনার মাহমুদা আক্তার লাকী জানান, গ্রেপ্তার পাঁচজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এরা নকল পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে কিডনি নিয়ে নিত।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.