শিল্পকলার সংগ্রাম ও একজন জয়নুল ।।প্রবীর সরদার
আগস্ট ২৭, ২০১৫
প্রবীর সরদার
জয়নুল আবেদিন আমাদের শিল্পকলার সংগ্রামের প্রবাদ পুরুষ। এ দেশের শিল্প আন্দোলনে তিনি যে ভূমিকা রেখে গেছেন আজ তা মহীরুহ আকারে প্রকাশিত। তাঁর ছবি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ ও সমাজের কাছে একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতার কথা। গণমানুষের প্রাত্যহিক জীবন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, দুর্বিপাক সবই উঠে এসেছে তাঁর ক্যানভাসে। কত সহজে তিনি বড় মাপের সব ছবি আঁকতেন; সেখানেও রয়েছে অভিনবত্ব। কালো কালিতে বেশির ভাগ ছবিই তিনি এঁকে গেছেন; এবং সেগুলোই বাংলার চিত্রকলার বিখ্যাত ছবির মর্যাদা পেয়েছে।
দেশের চিত্র তথা শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ায় তিনি অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। আর এর পেছনে কাজ করেছে তার দূরদর্শি চিন্তাচেতনাসহ কঠোর ত্যাগ ও পরিশ্রম। তাঁর শিল্পে মানুষেরা খুবই সাধারণ। সমাজের অবহেলিত চাষি, মজুর, জেলে, মাঝি, গাড়োয়ান, সাঁওতাল কন্যা, বেদেনী, মা- এরাই বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে তাঁর ক্যানভাসে। তাঁর সময়কালও ছিল এমনই, যখন মড়ক-দুর্বিপাক হানা দিচ্ছে বাংলার ঘরে ঘরে। কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষের ডাস্টবিন থেকে খাবার খাওয়ার দৃশ্য, মানুষের লাশ ঠোকরাচ্ছে কাক ও শকুন; ফুটপাতে, রাস্তায় পড়ে থাকা নিরন্ন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি তাঁর মননশীলতার অনন্য প্রকাশ। একজন শিল্পী সমকালীন ভাবনা বা শিল্পের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ হলে তিনি এই বিষয়গুলো উপজীব্য করে হাতে তুলে নিতে পারেন তুলি-ক্যানভাস। আসলে জয়নুল আবেদিনের ছবি না দেখলে এটা বোঝা যায় না।
১৯৭০ সালে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘নবান্ন’। এটি শিল্পকলার আরেক অনবদ্য সৃষ্টি। এই ছবি দেখে যে কোনো মানুষের ভেতরই শিল্পবোধ ছায়া ফেলবে এটা খুব স্বাভাবিক। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়। এর ব্যাপক মানবিক ক্ষতি শিল্পীকে ব্যথিত করে। তিনি আঁকেন ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা-৭০’ ছবিটি। জয়নুলের ছবি দেখে যে কারো মনেই বাংলায় ঘটে যাওয়া অজস্র দুর্দিনের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
তিনি তাঁর তুলিতে যে সময় ধরে রেখেছেন তা দিয়ে যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারবে বাংলার দুর্দিন ও উৎসবের যুথবদ্ধ ইতিহাস। বাংলায় তিনি যে শিল্প আন্দোলন করেছেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ চারুকলা ইনস্টিটিউট। কোন অবস্থা থেকে আজ চারুকলা ইনস্টিটিউট বাংলার শিল্প আন্দোলনের প্রধান বিদ্যাপীঠ হয়ে সারা দেশে শিল্প আন্দোলন ছড়িয়ে দিচ্ছে আজ তা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। এই মহৎ কর্মযজ্ঞের রূপকার ও স্বপ্নবান মানুষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
এই মহান শিল্প সংগ্রামীর জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায়। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিণী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছ থেকেই। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকা পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরও কত কি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধুমাত্র কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতা চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। তাঁর মা ছেলের আগ্রহ দেখে গলার হার বিক্রি করে তাঁকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ছেলে অবশ্য মায়ের সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছেন স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।
জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ হলে জন্ম হয় দুটি রাষ্ট্রের। জয়নুল পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা চলে আসেন। তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের চাকরি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত নর্মাল স্কুলে আর্ট-শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তাঁর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা, তৎকালীন শিল্পী সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং কতিপয় বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সাহায্য ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়েই সম্ভব হয়েছিল ১৯৪৮ সালে এ দেশে প্রথম আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার। তখন এর নাম ছিল ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’।
এই ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব তিনি নিজকাঁধে নেন। গ্রহণ করেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষের পদ। তাঁর মূল ভাবনা ছিল, এ দেশের তরুণদের শিল্পমনস্ক করা। রাজধানী শহর ঘুরে ঘুরে তিনি আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থী, মডেল খুঁজে বেড়াতেন এবং এসব নিয়েই কাটতো তার সময়। পথ চলতে চলতে তিনি একদিন আবিষ্কার করলেন মমিন মৃধাকে(প্রয়াত চারু দাদু)।
মমিন মৃধা তখন এক ম্যাজিস্ট্রেটের বাসায় মালির কাজ করতেন। শিল্পাচার্য তাঁর দেহের গঠন দেখে বুঝে ফেলেন যে, তাঁকে দিয়ে আর্ট স্কুলের মডেলের কাজ করানো যাবে। এভাবে মমিন মৃধা থেকে শুরু করে অনেককেই তিনি বাবা-মা’র কাছে বলে নিয়ে আসতেন। তাঁর স্বপ্নের চারুকলার আন্দোলন তিনি এভাবে করেছেন। মাত্র দু’কামরার সেই ইনস্টিটিউট ১৯৫৬ সালের মধ্যেই তিনি এক অতি চমৎকার আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন।
তাঁর স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠান পরবর্তীকালে ‘পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’ এবং স্বাধীনতার পরে ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত হয়। (আরো পরে মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং এর বর্তমান পরিচয় ‘চারুকলা ইনস্টিটিউট’ নামে)।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে যারা পড়তে এসেছেন, তারা পরে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। কথাটি এ জন্যই বলা যে, দেশের ছেলেরাও এর বাইরে কখনও ছিল না। তারা বরং চারুকলা আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশজুড়ে। এই শিল্প আন্দোলন শিল্পাচার্যের স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন। এই মহান শিল্পী শুধু বাংলার শিল্পীই নয়, বাংলার শিল্প আন্দোলনেরও রূপকার। জয়নুল আবেদিন দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮মে মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম শতবর্ষে এই শিল্পী সংগ্রামীর স্মৃতি ও সৃষ্টির প্রতি জানাই মুগ্ধ অভিবাদন এবং প্রাণের অশেষ প্রণতি।