চেতনার ও জাগরণের কবি নজরুল

আগস্ট ২৭, ২০১৫

kobiকবি নজরুল ইসলাম ১১ জ্যৈষ্ট ১৩০৬ বাংলা, ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার ‘চুড়ুলিয়া’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্য জগতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শুধু উন্নত ও সমৃদ্ধই করেননি, বিশ্ব দরবারে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিতও করেছেন। মৌলিক কাব্য-প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন বলেই এখনও তিনি যুগ প্রবর্তক কবি হিসেবে স্বীকৃত। বিদ্রোহী কবি বলে সমাধিক খ্যাত কবি নজরুলের মরমী কবিতা, অসংখ্য গজল,গান, হামদ-নাত, আজও পাঠক-শ্রোতাকে সমভাবে আপ্লুত করে রাখে। কাজী নজরুল যে বিশাল সাহিত্য ভান্ডার রচনা করেছেন তার তুলনা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। তিনি যে কত বড় কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না।
বাংলা সাহিত্যে যার আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো, তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি, নিপীড়িত মানুষের কবি, বিদ্রোহী কবি, তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল। কাজী নজরুল ইসলামকে চেতনা ও জাগরণের কবিকে বলা হয়। তিনি মূলত একজন কবি হলেও সাহিত্যের সব শাখাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নজরুল শুধু শিল্পী-সূরকার, গীতিকার, কবি, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক ও আপোষহীন সৈনিকই নন। তিনি ছিলেন সেকালের শক্তিধর এক কলমযোদ্ধা। তাঁর লিখনীতে ফুটে ওঠেছে বিদ্রোহী মানুষের চাওয়া-পাওয়া। কবি তাঁর ক্ষুরধার লিখনীর মাধ্যমে অন্যায়, জুলুম ও অত্যাচারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। যা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল, ‘বজ্রের ন্যায় কঠিন, হীরার চেয়ে ধারালো’। এ কারণেই বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুল স্বপ্রতিভায় চির সমুজ্জ্বল। গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প, গান-গজল সব শাখাতেই বিচরণ ছিল মহাপ্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলামের। কেবল গানই সৃষ্টি করেছেন চারহাজারের কাছাকাছি। এত গান পৃথিবীতে আর কোন কবি-গীতিকার লিখেছেন বলে জানা নেই। গান ছাড়াও রয়েছে তার অজস্র ছড়া-কবিতা। লিখেছেন বেশ কিছু ছোট গল্প ও উপন্যস। লেখালেখির পাশাপাশি সুর সৃষ্টি ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। এমন কি চলচ্চিত্র পরিচালক, সূরকার, গায়ক ও অভিনেতা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ‘নবযুগ, অর্থ সাপ্তাহিক, ধুমকেতু, লাঙল ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব ও পালন করেছেন।
তিনি ছিলেন তৎকালীন যামানার কাঁটাভরা দুর্গম পথের এক নির্ভীক সাংবাদিকও। তিনি বড়দের জন্য লিখেছেন অনেক অনেক প্রবন্ধ-গল্প ও কবিতা। তাই বলে নজরুল ছোটদের ভুলে যাননি। নজরুল ছোটদের জন্য রেখে গেছেন শিশুসাহিত্যের এক সুবিশাল ভান্ডার। লিখেছেন অনেক ছড়া- কবিতা। বড়দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হল যে, নজরুল একজন মানবতাদী কবি, যিনি সাধারণ মানুষের জন্য লিখেছেন, মানবতার গান গেয়েছেন, স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ নজরুলকে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এনেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সত্য, কিন্তু আমরা আজ তাকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। নজরুলকে উচ্চাসনে বসিয়ে দিয়ে তাঁর থেকে মই কেড়ে নিয়েছি। নজরুল যে বিদ্রোহের গান গেয়েছিলেন সেই বিদ্রোহ আজ রহিত হয়ে গেছে! বাঙালি মুসলমান আজ নির্জীব-অসার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে নজরুলের অবস্থান দেখলে মনে হবে যে বাংলার সবচেয়ে অপ্রসিদ্ধ কবি! নজরুল নিভু নিভূ আলোয় কোনমতে টিকে আছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে বাংলা বিভাগ রয়েছে, সেখানে নজরুল সাহিত্য থেকে স্বল্প পরিসরে কবি নজরুলকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতীয়ভাবে নজরুলচর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের দেশে নজরুল অনুশীলন অত্যধিক মাত্রায় কম হচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউট নজরুলচর্চায় যে অবদান রাখছে, তাও খুব সামান্য। বাংলা একাডেমীও উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখছে না। জাতীয় পর্যায়ে নজরুলচর্চা আমাদের দেশে হচ্ছেই না বললে চলে। আমরা তাঁকে চেতনায় ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। কবি নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন অন্য সব কবির চেয়ে ভিন্ন মাত্রায় বেশি হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু হচ্ছে এর বিপরীত।
বিশ্বকবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুেের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে যেভাবে বর্ণিল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও নানা আয়োজন করা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে মলিন আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়ার মতো। কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী দুঃখভরা কণ্ঠে বলেছেন, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চর্চা শুধু জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতেই সীমাবদ্ধ। এই দুটি দিন ছাড়া কবিকে সেইভাবে চর্চা বা স্মরণ করা হয় না’। যা সত্যিই কিন্তু দু:খজনক।
আজ ‘জাতীয় কবি’ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পান না, যেমনটি পেয়ে এসেছেন কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ বাংলা সাহিত্যে-সংস্কৃতি,দেশপ্রেম, আন্দোলনসহ কোন দিকে থেকেই নজরুলের ভূমিকা ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তিনি চিরকাল শোষিত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও সংগীত জগতে তিনি নিয়ে এসেছেন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য।
জাতীয় কবির প্রতি উপেক্ষা দুঃখজনক! তার প্রতি অবহেলার একমাত্র কারণ তিনি ইসলামী চেতনা ও আদর্শকে পুরোপুরিভাবে বিসর্জন দিতে পারেন নি ফলে নজরুল রয়ে গেলেন বাঙালী সমাজে অবহেলিত। তাঁর কবিতা ও গান-গজল আমাদের সংস্কৃতির চিরসম্পদ। তাঁর দেশাত্মবোধক কবিতাগুলো লাখ লাখ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং অনুপ্রাণিত করেছে বীরত্বপূর্ণ ও নিঃস্বার্থ কাজে আত্মনিয়োগ করতে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি, তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই আমাদের জাতীয় সম্পদ।  আমরা যদি নজরুলের জীবন ও সাহিত্য থেকে এই আদর্শটুকু গ্রহণ করতে পারি তাহলে তাঁর আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবেএবং সমাজ অনেকখানি স্বচ্ছতার দিকে এগিয়ে যাবে। নজরুল সাহিত্যকে বর্তমান প্রজন্ম ও আগামি প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা আমাদের উপর অপরিহার্য কর্তব্য।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন মাত্র ২৩ বছর। তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা মুক্তি (১৩২৬) বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায়। ৩টি ছিল কবিতা। প্রথম প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ প্রকাশিত হয় ‘সওগাতে’ ১৩২৬ সনে, কার্তিক সংখ্যায়। ছাপার হরফে আত্মপ্রকাশ ১৯১৯ সালে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারিতে। প্রথম গদ্য প্রবন্ধ ‘যুগবাণী’ (১৯২২)। প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২)। ২৩ বছরের শিল্প জীবনে নজরুল লিখেন ২২টি কবিতা গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ, ২টি কিশোর কাব্য, ৩টি উপন্যাস ৩টি গল্প গ্রন্থ ৩টি নাটক ২টি কিশোর নাটিকা ৫টি প্রবন্ধ গ্রন্থ, ১৪টি সংগীত গ্রন্থ। (আবদুল মান্নান সৈয়দ- নজরুল ইসলাম কবি ও কবিতা নজরুল একাডেমী ঢাকা- প্রথম প্রকাশ ২৯ আগস্ট ১৯৭৭)  নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি ছড়া-কবিতার প্রথম ক’টি লাইন উপস্থাপন করা হলো।
শিশুতোষ কবিতা:
‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে ওঠবো আমি ডাকি’।
‘ভোর হলো দোর খোল খুকমনি ওঠরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোটরে’
বিদ্রোহী কবিতা:
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভুমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত’
‘চল্ চল্ চল্!/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’
‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার’
প্রতিবাদী কবিতা:
‘কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান’
‘আমরা শক্তি আমরা বল/আমরা ছাত্রদল’
সাম্যবাদী:
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান’
‘ইসলামে বলে, সকলের তরে মোরা সবাই
সুখ দুখ সম-ভাগ ক’রে নেব সকলে ভাই’
ইসলামী সংগিত:
‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উচুঁ করি মুসলমানদ’
‘দাওয়াত এসেছে নয়া যামানার
ভাঙা কেল্লায় ওড়ে নিশান’
নাতে রাসূল সা.
‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
এলোরে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস
দেখবিখ যদি আয়’
‘তোরা দেখে যা মা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমার সথা চাঁদও দোলে’
হামদে তায়ালা:
‘শোন শোন ইয়া ইয়া ইয়ালাহী আমার মোনাজাত’
‘ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’
কাব্যগ্রন্থ:
অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, সিন্ধু-হিন্দোল, সর্বহারা, জিঞ্জির ইত্যাদি।
গানের গ্রন্থ:
বুলবুল, চোখের চাতক, বনগীতি,গানের মালা,চন্দ্রবিন্দু।
শিশুতোষ:
ঝিঙেফুল, সাত ভাই, চম্পা, নতুন চা।
উপন্যাস:
বাঁধনহারা, কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষূধা।
নাটক:
ঝিলমিলি,আলেয়া, মধুমালা।
প্রবন্ধগ্রন্থ:
যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী ইত্যাদি।
শেষ কথা: ইসলামী জাগরণের কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, চেতনার কবি, জাতীয় কবি নজরুকে স্বল্পমূল্যায়ন ঠিক নয়। নজরুলের জীবন ও সাহিত্য থেকে অফুরন্ত শিক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তী জীবন সংগ্রামে কাজে লাগাতে হবে। আর এজন্য বেশি বেশি নজরুল সাহ্যিত্যচর্চা ও তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে সর্বস্তরের নজরুলচর্চা ছড়িতে দিতে হবে। নজরুল চর্চার মধ্য দিয়ে এ দেশের  মুসলমানদের ঈমান-একতা, সম্মান-মর্যাদা, সাহস-হিম্মত, দায়িত্ব-কর্তব্য, দেশপ্রেম-ধর্মপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য,সভ্যতা-সংস্কৃতি ফিরে পেতে হলে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হলে, নজরুলকে জানতে হবে, তাঁর সাহিত্য ও আদর্শকে গ্রহণ করতে হবে। কবি নজরুল তাঁর প্রতিভাগুণে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং যুগ যুগ ধরে আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক:এহসান বিন মুজাহির, সাংবাদিক, কলাম লেখক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.