চুম্বন: তসলিমা নাসরিন

জুলাই ২৭, ২০১৫
Deepika-eiচুম্বন- তসলিমা নাসরিন : আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি সুশান্তর দিকে। দরজার কাছে আমিও এসেছিলাম সুশান্ত যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করবো বলে। ঠিক বুঝে পাই না সুশান্ত কী বলছেন, কেন বলছেন। কোনও কথা না বলে সুশান্ত আমার হাত ধরে কাছে টেনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন আমার ঠোঁটে, জিভে, অনেকক্ষণ। আমার সারা শরীর তিরতির করে কাঁপছিল তখন।
১.

সুশান্ত সিনহা আমার সাক্ষাত্কার চাইছেন। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করে করে মাস ছয় পার করেছি। আবার যখন ফোন করলেন সাক্ষাত্কার চেয়ে, আমি খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম, আপনার ঠিকানাটা বলুন তো।

-ঠিকানা কেন?

-ঠিকানা চাইছি কারণ আপনার সঙ্গে আমি দেখা করতে যাবো।

-তাহলে সাক্ষাত্কার দিচ্ছেন? আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো।

সুশান্তর ঠিকানায় সেদিনই আমি পৌঁছে যাই। মান্ডি হাউজে দূরদর্শন বিল্ডিং। তারই চারতলায় সুশান্তর অফিস। টেবিল উপচে পড়ছে ফাইলে। এর মধ্যে ঘাড় গুঁজে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক চিঠি লিখছেন। হাতে ঝরনা কলম। চারদিকটা দেখে একটি চেয়ার টেনে বসে বললাম, তাহলে আপনিই সুশান্ত সিনহা।

-আজ্ঞে। আমিই। আমিই সুশান্ত সিনহা।

-আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় একজিস্ট করেন না। তাই দেখতে এলাম, যে মানুষটা এতগুলো মাস নিরলস ফোন করে যাচ্ছেন, উনি কি আসলেই কেউ?

সুশান্ত জোরে হেসে উঠলেন।

-কী ভেবেছিলেন? ভূত টুত কিছু?

-ভূতে বিশ্বাস করলে তাই করতাম।

-এখন দেখছেন আমি আসলেই কেউ। আমি একজিস্ট করি। সাক্ষাত্কার আজ দেবেন তো?

-না, আমি সাক্ষাত্কার দিতে আসিনি।

সুশান্ত সিনহা বিস্মিত হন। তাঁর চোখের মণি স্থির হয়ে থাকে।

আমি হেসে বলি, চা টা পাওয়া যাবে আপনার অফিসে?

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই বলে টেবিলের ওপর রাখা একটা বেল টিপলেন। পাশের ঘর থেকে এক যুবক এসে দাঁড়ালো। চা নিয়ে এসো। কালো চা। চিনি ছাড়া।

-কী করে জানলেন আমি দুধ-চিনি ছাড়া চা খাই। আমি জিজ্ঞেস করি।

সুশান্ত সিনহা  হাতের সামনের কাগজটা  সরিয়ে রেখে হাতের কলমটা গুটিয়ে সার্টের পকেটে রেখে বললেন, আপনি বিখ্যাত মানুষ, আপনি কী খান, কী পরেন, সব খবর আমরা, মানে পাবলিকরা জানি।

-আচ্ছা বলুন তো। আমার সাক্ষাত্কার চাইছেন কেন। আমি কী এমন হাতি না ঘোড়া?

সুশান্ত সিনহা মধুর হাসি হেসে বললেন, আপনি হাতিও নন, ঘোড়াও নন। আপনি প্রিয়াংকা ঘোষাল। যাকে এক নামে সবাই চেনে।

-রাখুন আপনার এক নামে সবাই চেনে স্তুতি। পটাচ্ছেন বুঝি? আমি কিন্তু সাক্ষাত্কার দেবো না। চা খেয়ে উঠবো।

-এলেন কেন তবে?

-ইচ্ছে হলো, তাই।

চা  এলো। ঠাণ্ডা চা। প্রথম চুমুকেই বুঝে যাই চায়ের পাতাটা ভালো নয়। কাপটা ঠেলে সরিয়ে দিই। সুশান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, উঠছি আমি। চায়ের জন্য ধন্যবাদ।

-কিন্তু চা টা না খেয়েই উঠবেন?

-হ্যাঁ না খেয়েই। কারণ চা টা খুব বিচ্ছিরি হয়েছে। এত খারাপ চা আমি খাই না। আমি দার্জিলিং চা খাই। পারলে একদিন আমার বাড়ির চা খেয়ে যাবেন। চা কাকে বলে একটু বুঝে যাবেন।

-নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

সুশান্ত সিনহা দাঁড়ালেন।

-কাল আসি, ম্যাডাম?

-কালই? কেন?

-চা খেতে।

-ও।

দেখতে আপাদমস্তক এক ভদ্রলোক। আমার টিপ্পনীকে নেমন্তন্ন ভেবে নিয়েছেন! ভদ্রলোককে আর দশটা’ ভদ্রলোকের মতো ভদ্র মনে হলেও আদপেই তিনি ভদ্র নন।

বেরিয়ে যেতে যেতে বলি, ঠিক আছে, চা খেতে আসুন কাল। নিশ্চয়ই আমার সবকিছু যখন জানেন, ঠিকানাটাও জানেন।

সুশান্ত সিনহা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ জানি। কে টুয়েনটি ফোর, চিত্তরঞ্জন পার্ক।

উনি নিচে নেমে এলেন আমার সঙ্গে। গাড়িতে উঠলাম। উনি হাত নাড়লেন।

সুশান্ত সিনহার হাসিটা মনে গেঁথে রইলো। চেহারাটাও। নিঃসন্দেহে সুদর্শন তিনি। ছা-পোষা কেরানির মতো তাঁর কাজকর্ম। ২০১৫ সাল, এখনও হাতে চিঠি লেখেন। ঘরের এক কোণে একটা কমপিউটার। কিন্তু ওটা আদৌ ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণের পরিচয়ে আমি আজ অবধি কাউকে বাড়িতে আসতে বলিনি। হয়তো বলতে পারতাম, না ওটা বলার জন্য বলা। ওটা সত্যিকারের চা খাওয়ার নেমন্তন্ন নয়।

 

সুশান্ত সিনহা পরদিন এলেন বড় এক ফুলের তোড়া নিয়ে। আমার প্রিয় ফুল। সাদা লিলি। কী করে জানেন আমার প্রিয় ফুলের কথা। কোথাও হয়তো কখনও আমার পছন্দ অপছন্দের কথা  ছাপা হয়েছে। পড়েছেন এবং  আজও মনে রেখেছেন। ড্রইং রুমে বসলেন। চা বানিয়ে আনলাম। তিনি নিজে দুধ চিনি দিয়ে চা খান। কিন্তু আমার কাছে এসে খেলেন, আমি ঠিক যেরকম চা খাই, সেরকম।

-কেউ থাকে না আপনার সঙ্গে?

– এতকাল  একাই  ছিলাম। ইদানীং একজন থাকছেন সঙ্গে।  আমার তো সবই জানেন আপনি। কেন খামোকা জিজ্ঞেস করছেন?

সুশান্ত সিনহা আবার তাঁর মধুর হাসিটি হাসলেন। বললেন, না না, কী বলছেন। সব জানবো, এত সৌভাগ্যবান কি আমি? সামান্য কিছু জানি। সাংবাদিকদের এটুকু জানতেই হয়।

-ও। তাই বুঝি। কোন ফুল ভালোবাসি সেও তো জানেন?

-এসবকে কোইনসিডেন্সও বলতে পারেন।

বেশিক্ষণ বসেননি সুশান্ত সিনহা। চা খেয়েই চলে গেলেন, বললেন, চা খেতেই যেহেতু এসেছিলেন, তাই চায়ের বাইরে আর সময় নষ্ট করা তাঁর উচিত নয়। আমার একবার বলতে ইচ্ছে করেছিলো, সে কি, এত দূর থেকে এসেছেন, এত অল্প সময়ের জন্য? বলিনি কারণ চায়ের জন্যই তো আসা। আর এ লোক তো আমার বন্ধু নন যে গল্প করার দরকার আছে। দু’ ঘণ্টা আসতে, দু’ ঘণ্টা যেতে। এই চার ঘণ্টা সময় চায়ের জন্য ব্যয় করে তিনি একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি চা নিয়ে। চায়ের অ্যারোমা নিয়ে একটি শব্দ নয়। আস্ত অভদ্রলোক। এত সময় কেউ কেবল চায়ের জন্য খরচ করে! এমন নয় যে চা নিয়ে গবেষণা করছেন উনি।

 

আমি এরপর সুশান্ত সিনহার ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। যখনই ফোন বাজে, মনে হয় এ সুশান্ত। ইচ্ছে করে তাঁকে ফোন করতে। কিন্তু ফোনে কী বলবো? সুশান্ত হয়তো ভাববেন আমি সাক্ষাত্কার দিতে চাইছি। আমি কিন্তু চাইছি না। তাহলে কি তাঁকে বলবো, না, এই ফোন সাক্ষাত্কারে রাজি হওয়ার ফোন নয়। তবে কী ফোন এই ফোন? আমি উত্তর জানিনা বলে ফোন করিনি।

ফোন সাত দিন পর করেন সুশান্ত। আবারও ওই সাক্ষাত্কারের কথাই জিজ্ঞেস করেন।

আমি বলি, যদি সাক্ষাত্কার দিই কোনওদিন, যদি ইচ্ছে হয় কোনওদিন। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কী প্রশ্ন করবেন?

সুশান্ত বললেন, প্রায় তেইশ  বছর আগে গর্ভবতী হয়েছিলেন। না, কারও সঙ্গে প্রেম করে নয়, কারও সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে নয়। স্পার্ম ব্যাংক থেকে অচেনা লোকের স্পার্ম নিয়ে। ঘোষণা করেছিলেন, সন্তান নারীর, পুরুষের নয়। নিজে সন্তান প্রসব করে গোটা ভারতবর্ষকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আপনার পরে কিন্তু আর কেউ ওই কাজটা করেনি। করলেও ঘোষণা করেনি। আপনার পথ কি কেউ অনুসরণ করেছে বলে জানেন?

-দ্বিতীয় প্রশ্ন?

-আপনার মেয়ে কি জানে তার যে বাবার পরিচয় নেই? সে কি শুধু মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে সন্তুষ্ট? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সামনে অসুবিধে হয় না? টাইটেলটাও তো মায়েরই?

-তৃতীয় প্রশ্ন?

-মেয়ে কি আপনাকে দোষ দেয়? বলে, তোমার নারীবাদের ভিকটিম করেছো আমাকে, বা এই ধরনের কিছু?

-আপনার কি আরও কোনও প্রশ্ন আছে? আমি জিজ্ঞেস করি।

সুশান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, সবে তো শুরু হলো, আরো অনেক প্রশ্ন আছে। কবে সাক্ষাত্কার দেবেন ম্যাডাম?

-না, আমি ইন্টারভিউ দেবো না।

-তবে প্রশ্ন শুনতে চাইলেন কেন?

-চাইলাম।

-চাইলাম মানে? আমাকে একটা ফালতু লোক ভেবেছেন?

-না। মোটেও না। আসলে আপনি আমাকে ফালতু লোক বলে ভাবছেন?

-ফালতু লোক ভাবলে ইন্টারভিউ নিতে চাইতাম?

-হ্যাঁ চাইতেন। আপনি ভেবেছেন আমি একটা ফালতু কাজ করেছি, আমি একটা ফালতু মেয়েছেলে। তাই আমাকে আরও বেশি ফালতু হিসেবে দেখানোর জন্য আপনি আমার ইন্টারভিউ চেয়েছেন।

-বাজে বকবেন না।

-বাজে বকছি না।

সুশান্ত বললেন, আমি আসছি। আপনার বাড়িতে আসছি।

-কেন?

-এসে বলবো।

দু’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে সুশান্ত সত্যি সত্যি এলেন। অনেক কাজ ফেলে চলে এলেন। বললেন, আমাকে ভুল বুঝবেন না, প্রিয়াংকা।

আপনাকে আমি ভুল নয়, ঠিকই বুঝছি সুশান্ত বাবু। আপনি এ দেশের নারীবিদ্বেষী লোকদের চেয়ে মোটেও পৃথক কিছু নন। আমি ভেবেছিলাম, কুড়ি বছর পার হয়েছে, সমাজটা বোধহয় কিছুটা সভ্য হয়েছে। কিন্তু দেখছি, যা ছিল তাই আছে। সে কারণে আমি হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষ ছাড়া আর কারও সঙ্গে মিশিটিশি না।

সুশান্ত দু’হাত জড়ো করে বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি সেরকম লোক নই। আসলে আমি চাইছিলাম, যারা আপনাকে ভুল বোঝে, তারা আপনার মুখ থেকেই শুনুক আপনার ব্যাখ্যাটা, তাদের ভুলটা ভাঙুক।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, দেখুন সুশান্তবাবু, ভুল বোঝাবোঝির ব্যাপার নয়। এখানে দুটো মত। এক মত হচ্ছে, নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা। আরেক মত হচ্ছে, বিশ্বাস না করা। যারা আমার কাজকে মানে না, তারা সচেতনভাবেই মানে না। তাদের মত বদলানোর জন্য চেষ্টা করার কোনও দরকার আমার নেই। বদলালে নিজেরাই বদলাবে। আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। নিজেকে ডিফেন্ড করা আমার কাজ নয়। কারণ আমি মনে করি না…

-আপনি মনে করেন না আপনি কোনও ভুল করেছেন।

-হ্যাঁ, তাই।

সুশান্ত হাতে করে এক তোড়া ফুল এনেছিলেন। ফুলগুলো টেবিলে ওভাবেই পড়েছিল। হঠাত্ উঠে বললেন, ফুলদানি কোথায় বলুন তো, ফুলগুলোকে জলে না রাখলে মরে যাবে।

সোফায় যেভাবে বসে ছিলাম আমি, সেভাবেই বসে থাকি। সুশান্ত রান্নাঘর থেকে নিজেই একটা ফুলদানি জোগাড় করে নিয়ে ওতে ফুলের তোড়া রাখলেন। ঘরের ভেতর সুশান্তর এই হাঁটাচলা আমাকে, আমি জানি না কেন, ভালো লাগা দেয়। এভাবে তো বিনয়ও হাঁটে। কিন্তু দেখতে তো এত ভালো লাগে না। সুশান্তর এই ফুল হাতে নিয়ে বাড়ি আসা, ক্ষমা চাওয়া আমার রাগটাকে অনেকটা কমায়। সুশান্ত আর সব লোকের মতোই। তারপরও সুশান্ত একটু আলাদা। হঠাত্ বললেন, চলুন দার্জিলিং চা পান করি। করবেন তো? চা আজ আমি বানাবো? আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। সোফায় পা উঠিয়ে চুপচাপ বসে বসে দেখি। আমি যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে সুশান্তকে রান্নাঘরে দেখা যায়। দেখি তিনি কেটলি খুঁজছেন, চায়ের পাতা খুঁজছেন, কাপ খুঁজছেন। মনে মনে বলি, খুঁজুন। মেয়েরা তো যে কোনও রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজে সব পেয়ে যায়। একবার ছেলেরা পাক। জন্ম থেকে তো এদের মাথাটা বিগড়ে দেয় পরিবারের লোকেরা, এরপর সমাজ বিগড়ায়। এসব কাজ নাকি মেয়েদের কাজ। এসব যে ছেলেদেরও কাজ, তা এরা মৃত্যু অবধি জানে না। মৃত্যুর পর অবশ্য জানার প্রশ্ন ওঠে না। মৃত্যুই তো সব শেষ। সুশান্তও বিশ্বাস করেন মৃত্যুর পর আর কোনও জীবন নেই। শুধু বিনয়টাই মানলো না।

অনেকদিন আমি ছবি আঁকি না। ইচ্ছে করছে, সুশান্ত আজ বসে থাকুন, ওঁকে আমি আঁকবো। মনের খাঁচায় ইচ্ছেটাকে বন্দি করে রাখি। সুশান্তর বানিয়ে আনা চা খেতে খেতে লক্ষ করি সুশান্ত অপলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ফুলপাতাগুলোর আড়ালে তাঁর মুখটার অনেকটাই ঢাকা। কিন্তু চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। আমিও যখন চোখদুটো দেখতে থাকলাম, সুশান্ত সরিয়ে নিলেন চোখ।

-মেয়ের নাম তো চুম্বন। তাই না?

সুশান্ত হঠাত্ প্রশ্ন করেন।

-হ্যাঁ। চুম্বন।

-এখন আছে কোথায়? নিউ ইয়র্কেই?

মাথা নাড়ি।

-চুম্বন কার মতো দেখতে হয়েছে? আপনার মতো নাকি ওর বাবার মতো?

-এই প্রশ্ন কেন সুশান্তবাবু, আপনি এত কিছু জানেন আমার সম্পর্কে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন ওর বাবা বলতে কেউ নেই। অথবা ওর বাবা কে আমি জানি না, কোনওদিন দেখিনি।

-হ্যাঁ তা জানি। ইচ্ছে করে অচেনা কোনও জায়গা থেকে অচেনা লোকের স্পার্ম নিলে বাবা কে জানার তো প্রশ্ন ওঠে না। ইচ্ছে করলে জানতে পারতেন কে,  কিন্তু জানতে তো চাননি।

-সবই তো জানেন। এও জানেন আমি নিজের সন্তান চেয়েছিলাম। অন্যের সন্তান নয়। চুম্বন আমার সন্তান। ওর কোনও বাবা নেই। ওর আছে শুধু মা। বাই দ্য ওয়ে, চুম্বন দেখতে আমার মতো।

-ওর ছোটবেলার ছবিগুলো দেখেছি, তখন তো পেপারে বেশ ছাপা হতো। বড় হয়ে ঠিক কেমন দেখতে হলো…

-তা দেখেননি তো! ওর এখনও বেবি ফেস। খুব একটা চেঞ্জ হয়নি।

-আপনার মতো?

-মানে?

-ওই বেবি ফেস-এর কথা বললেন তো, তাই।

এত অল্প চেনা মানুষটি আমার ত্বক ট্বক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, বেশ অস্বস্তি হয়।

-ওকে মিস করেন? সুশান্ত জিজ্ঞেস করেন।

-কাকে? চুম্বনকে?

-হ্যাঁ। নিশ্চয়ই করি।

সুশান্ত বেরিয়ে যান। মানুষটা ভীষণ ব্যস্ত, বুঝি। আমার আর বলা হয় না, ওঁকে যে আমার আঁকতে ইচ্ছে হয়েছিল। ইচ্ছেগুলো পুষে রাখি। ব্যস্ত মানুষ কি স্থির হয়ে বসবেন আমার ইজেলের সামনে কিছুদিন?

আমার এই ইচ্ছেগুলোর কথা বিনয় জানে না। বিনয় সকালে উঠে ইওগা করবে, স্নান করবে, পুজো করবে, ওটমিল খাবে, বেরিয়ে যাবে। ক্লিনিকে যাবে। রোগী দেখবে। দুপুরে ক্লিনিকের রেস্তোরাঁতেই লাঞ্চ সেরে নেবে।  ফিরবে সন্ধ্যেয়। রাতে ঘরে বা বাইরে আমরা একসঙ্গে খাবো। আমার বিছানায় শোবে। শোওয়াটা অবশ্য ঘুম আসা পর্যন্ত। ঘুম পেলে বিনয় তার নিজের ঘরে চলে যাবে। আমিই বলেছি চলে যেতে। বিছানায় একা না হলে আমি ঘুমোতে পারি না। গেস্টরুমকেই বিনয়ের ঘর বানিয়ে দিয়েছি। আমার চেয়ে প্রায় পনেরো বছরের ছোট। নিশ্চয়ই একদিন বিয়ে করার জন্য পাত্রী পেয়ে যাবে। আমি বিনয়কে বলে দিয়েছি, যখন ওর বিয়ে টিয়ে করে সংসার করতে ইচ্ছে করবে, যেন চলে যায়, আমি মন খারাপ করবো না, বাধাও দেবো না। পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো, বিনয়ের যাওয়ার কোনও লক্ষণ আমি দেখি না। গত পাঁচ বছর, প্রতি রাতে ও আমার শরীর নিয়ে উন্মাদের মতো করে, এই শরীর ছাড়া, ও বলে, যে, অন্য কোনও শরীর ও চায় না। প্রতি রাতে ও দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ আমার পুরো শরীর সুখের জলে ডুবিয়ে রাখে। সুখে নিজেও ডুবে থাকে। বিনয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই। শরীরের।  মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি আমাকে ভালোবাসে কি না, বিনয় বলে, হ্যাঁ বাসে। আমাকে কখনও কিন্তু, লক্ষ করেছি, বিনয় জিজ্ঞেস করে না, আমি বাসি কিনা। ও নিশ্চয়ই ভাবে আমি বাসি না। নিশ্চয়ই ভাবে আমি শুধু সেক্সের জন্য ওকে এ বাড়িতে রেখেছি। আমি যে বিনয়কে ভালোবাসি, সামান্য হলেও বাসি, সেটা বোঝাতে পারি না। আসলে পঁচিশ বছর বয়সে ওই কাণ্ডটি ঘটানোর পর জীবনটাই বদলে গেছে। আমার সম্পর্কে আমার আর বলতে হয় না, আমার সম্পর্কে লোকে বলে। আমি কী ভাবছি কী করছি, তা আমি নই, অন্যরা ব্যাখ্যা করে। অবিবাহিত মেয়ে স্পার্ম কালেক্ট করে দুনিয়াকে জানিয়ে গর্ভবতী হয়েছে, সন্তান প্রসব করে, সগর্বে ঘোষণা করে দিয়েছে যে এ তার সন্তান, তার একার সন্তান, জানিয়েছে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কোনও স্বামীর প্রয়োজন হয় না, তার ইচ্ছে হয়েছে মা হওয়ার, সে হয়েছে, এ কি সহজ কথা? লোকে তখনই আমার গায়ে নারীবাদী তকমা ঝুলিয়ে দিয়েছে। নারীবাদীদের নিয়ে যে উদ্ভট কিছু ধারণা আছে মানুষের, সেসব দ্বারা আক্রান্ত হই অহরহ। যেমন আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছেলের সঙ্গে সেক্স করছি, নারীবাদী বলেই করছি। যে কারও সঙ্গে যখন খুশি শুতে পারি, নারীবাদী বলেই পারি। কোনও পুরুষের সঙ্গে যখন বছরের পর বছর আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না, তখন কিন্তু দুর্মুখগুলো বলেছে, পুরুষকে ঘৃণা করে প্রিয়াংকা, তাই কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে না। কী ভয়ংকর পুরুষবিদ্বেষী! বাচ্চা নিলো, কিন্তু বাচ্চার বাবাকে স্বীকৃতি দিলো না। নারীবাদী তো, সে কারণেই।

বিনয়ের কাছে একদিন ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে সুশান্তর কথা পাড়ি। সুশান্ত আমার সাক্ষাত্কার নিতে চাইছেন কিন্তু আমি রাজি নই। এও বলি, সুশান্ত দেখতে ভালো, ওঁকে বলবো আমার ছবির জন্য মডেল হতে।

বিনয় জিজ্ঞেস করলো, কেন সাক্ষাত্কার চায় লোকটা?

-চায়, যে কারণে অন্যরা চায়। বোধহয় এক্সাইটিং কোনও খবর পাচ্ছে না আজকাল। তাই দু’যুগ আগের ঘটনা নিয়ে পড়েছে। চুম্বন কত বড় হলো, কোথায় কী পড়ছে, এসব জানতে চাইছে। একেবারে হাঁড়ির খবর নিতে হবে এদের। এদের জ্বালায়ই  তো চুম্বনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি।

-ভালো ডিসিশান নিয়েছিলে।

বিনয়ের বাবা ছিলেন চুম্বনের ত্বকের ডাক্তার। ছোটবেলায় চুম্বনের ত্বকে একটা অসুখ হতো, সেই অসুখের চিকিত্সা বিনয়ের বাবাই করতেন। ধীরে ধীরে ডাক্তার পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কই গড়ে উঠেছে, আমার বাড়িতে ওঁদের যাওয়া আসাও ছিল। বিনয়ের বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হায়দারাবাদে চলে যাওয়ার পর বিনয়ের আর থাকার জায়গা ছিল না শহরে। শহরে বাড়ি ভাড়া করার ঝামেলাটা হয়নি, আমার বাড়িতেই উঠেছে সে। বাবা মা তার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখেন, বিনয় জানিয়ে দেয়, বিয়ে সে এখন করছে না।

হঠাত্ সে জিজ্ঞেস করে, লোকটার বয়স কীরকম?

-কার?

-সুশান্তর।

-ও। মনে হয় পঞ্চাশ টঞ্চাশ হবে।

শুনে বিনয় চোখ কপালে তুলে বললো, ওরে বাবা, অনেক বয়স।

-হ্যাঁ অনেক বয়স।

সুশান্তর অনেক বয়স বলেই হয়তো সুশান্তকে নিয়ে আমার আগ্রহের দিকে বিনয় নজর দেয় না। আমার চেয়ে বেশি বয়সের কোনও লোকের জন্য আমার কোনওরকম আগ্রহ জন্মাতে পারে না, এ ব্যাপারে বিনয় যেন নিশ্চিত।

২.

প্রচণ্ড ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও সুশান্ত সিনহা আমাকে সময় দিচ্ছেন। আমি তাঁকে ঠিক ঠিকই বসিয়ে ছবি আঁকছি। আমি ল্যান্ডস্কেপ আঁকি, পোরট্রেট খুব কম আঁকি। জানি না সুশান্তর পোরট্রেট আঁকার  জন্য হাত কেন নিশপিশ করছিল। কিছু কিছু সময় এমন হয়, কী করি, কেন করি, বুঝতে পারি না। সুশান্তকে কিছুদিন কাছে পাওয়ার জন্য কি? বিনয়কে কাছে পাওয়ার জন্য তো এত আকুল হই না। বিনয়ের কিছু ন্যুড এঁকেছিলাম। আমার আঁকা ছবিগুলো দেখতে গিয়ে সেই ন্যুডগুলোও দেখেছেন সুশান্ত। জিজ্ঞেস করেছেন,  কে, বয়ফ্রেন্ড বুঝি? আমি মাথা নেড়েছি। হ্যাঁ, বয়ফ্রেন্ড।

সুশান্তর ছবিটা ন্যুড নয়। একগাদা কাপড়চোপড় পরেই সুশান্ত বসেছিলেন। ছবিটা সাতদিনে শেষ হয়ে যায়। শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করেছেন,  এ ছবি তো বিক্রি হবে না, শুধুশুধু আঁকলেন কেন?

বলেছি, আমি টাকার জন্য সব কিছু করি না। এ আমার নিজের সংগ্রহের জন্য। আপনাকে মনে রাখার জন্য। দেখা কখনও আর নাও হতে পারে আমাদের।

সুশান্ত বললেন, দেখা না হলেই বা কী! কত কত লোকের সঙ্গে কখনও হয়তো আর দেখা হবে না আপনার। আপনি কি সবার ছবি এঁকে রাখেন মনে রাখার জন্য?

-না। তা আঁকি না।

-তবে আমারটা কেন আঁকলেন?

-ইচ্ছে হয়েছে তাই। সবারটা ইচ্ছে হয় না।

-ও। ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি তো আবার যা ইচ্ছে হয় তা করেন।

-বলুন। বলুন। বলুন নারীবাদী তো আমি, সে কারণেই যা ইচ্ছে হয় তা করি। পুরুষবাদীরাও কিন্তু যা তাদের ইচ্ছে হয়, তা করে। কিন্তু সে কথা চারদিকে কেউ এভাবে বলে বেড়ায় না।

ছবিটা দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি। কোথায় সুশান্ত চেয়েছিলেন আমার সাক্ষাত্কার। সাক্ষাত্কার দেওয়া  হলো না। বরং একটি ছবি উঠলো দেয়ালে। আমারই অর্জন হয় অন্যের বিসর্জনে। সুশান্ত বিস্মিত এবং অভিভূত, আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন যখন ছবিটা আমি ড্রইং রুমের দেয়ালে টাঙাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ঘটনাটি ঘটছে।

যখন আঁকছিলাম, সুশান্ত নড়াচড়া করেননি, কিন্তু অনর্গল কথা বলেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর বিবর্তন দিয়ে শুরু করে থেমেছেন নিজের জীবনে এসে ।  আমার জীবনের কিছু শুনতেও তাঁর আর বাকি নেই। আমার সব কথা জানার জন্যও হয়তো উনি মডেল হতে রাজি হয়েছেন। সাংবাদিকরা কী না পারেন! ছোট্ট কোনও নিউজ আইটেমের জন্য বরফ-ঠাণ্ডা নদীও সাঁতরাতে পারেন। অবশ্য আমি তাঁর নিউজ আইটেম নই। সাক্ষাত্কার যে দেবো না তিনি জানেন। মেনেও নিয়েছেন।

বিনয়কে আমি ভালোবাসি কিনা সুশান্ত জিজ্ঞেস করেছেন। বলেছি, মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না, কিন্তু মনে হয়, শুধু মনে হয় না, বিশ্বাসও হয় যে, ভালোবাসি।

৩.

ছবি আঁকার মাসখানিক পর হঠাত্ এক বিকেলে কলিং বেল বাজলো। সুশান্ত ঢুকলেন। হেসে বললেন, দার্জিলিং চা খেতে এলাম। বিনা নোটিশেই চলে এলাম।

চা বানিয়ে দু’জন খেলাম। সুশান্ত বললেন তিনি সাংবাদিক হিসেবে আমার কাছে আসেননি। জিজ্ঞেস করেছি, তবে কী হিসেবে এসেছেন। বললেন, বন্ধু হিসেবে। কিছুক্ষণ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে করে সুশান্ত উঠলেন। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চুম্বন মিস করেন?

-চুম্বনকে মিস করি কি না? মিস তো করিই। তবে ও ভালো কলেজে পড়ছে আমেরিকায়। সেটাই শান্তি। বছরে একবার অবশ্য আমার যাওয়া হয়, তবে…

-আহ, প্রিয়াংকা, চুম্বন মিস করেন?

আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি সুশান্তর দিকে। দরজার কাছে আমিও এসেছিলাম সুশান্ত যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করবো বলে। ঠিক বুঝে পাই না সুশান্ত কী বলছেন, কেন বলছেন। কোনও কথা না বলে সুশান্ত আমার হাত ধরে কাছে টেনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন আমার ঠোঁটে, জিভে, অনেকক্ষণ। আমার সারা শরীর তিরতির করে কাঁপছিল তখন।

সৌজন্যে- ইত্তেফাক।

ঢাকা জার্নাল, জুলাই ২৭, ২০১৫।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.