নতুন বছরের স্বপ্ন

জানুয়ারি ২, ২০১৫

Md_Zafar_407645771মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অনেক দিন থেকেই একটা পারিবারিক প্রোগ্রাম ছিলো। পরিবার এবং বৃহত্তর পরিবারের সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার সেন্ট মার্টিন্স বেড়াতে যাবো। ঠিক রওয়ানা দেয়ার আগে আমার ছোট বোন ফোন করে আমাকে খবর দিলো একটা ছোট শিশু একটা গভীর গর্তে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে একটু খুঁড়লেই পানি পাওয়া যায়, তাই গভীর গর্তে নিশ্চয়ই পানি থাকবে। যেসব গর্ত ব্যবহার হয় না, সেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হয়। তাই সেখানে মানুষ পড়ে গেলে বেঁচে থাকার কোনো আশা থাকে না। কিন্তু এই শিশুটির বেলায় একটু আশার খবর আছে যে, তার সাথে নাকি কথা বলা হয়েছে, তাকে জুস খেতে দেয়া হয়েছে। 

সারা রাত ধরে বাস চলেছে, আমি গভীর রাত পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছি। সাংবাদিকেরা সবার আগে খবরটা পেয়ে যাবে বলে তাদের ফোন করেছি। চারিদিকে কতো রকম মন খারাপ করা খবর তার মাঝে যদি এই শিশুটিকে উদ্ধার করে ফেলা যায়, তার সুখের একটা হাসি যদি দেশের মানুষ দেখতে পারে এক মুহূর্তে পুরো দেশের মুখে হাসি ফুটে উঠবে। আমি সেই হাসিটির জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো দেশের মানুষের মন ভালো হলো না, গভীর বিষাদে সবার মন ভেঙে গেলো। শিশুটিকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা হলো কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় নয়, মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সে দেশের সবার মন ভালো করে দিতে পারলো না। শুধু তাই নয়, তার আগে আরো মন খারাপ করা খবর আছে পুরো বিষয়টাই একটা গুজব এবং সেই গুজব ছড়ানোর জন্যে শিশুটির বাবাকে আটক করা হয়েছে, অন্য শিশুদের আটক করা হয়েছে এরকম খবরও পেয়েছি। এই গর্তে আসলে শিশুটি নেই সেজন্যে উদ্ধার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেটাও শুনেছি। 

যখন কেউ মারা যায় তখন আপনজনেরা একে অন্যের পাশে থেকে দুঃখটা ভাগাভাগি করে নেয়। এখানেও তাই হয়েছে, দুঃখটা পুরো দেশের মানুষ ভাগাভাগি করে নিয়েছে, গভীর ভালোবাসা দিয়ে এই ছোট শিশুকে বিদায় দিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র দপ্তর কিংবা পুলিশের হৃদয়হীন বক্তব্য কিংবা আচরণে সাধারণ মানুষ যে রকম ক্ষুব্ধ হয়েছেন দুঃসময়ে তরুণদের এগিয়ে আসার সেই অসাধারণ ভূমিকা দেখে আবার মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। আমরা অসংখ্যবার এই বিষয়টি দেখেছি, ঠিক যখন দরকার হয়েছে তরুণেরা এগিয়ে এসেছে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় বিভাগ, বড় বড় অধ্যাপক তাদের ছাত্রছাত্রীরা তাৎক্ষণিকভাবে একটা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হতে পারে না, কিন্তু সাধারণ মানুষ একেবারেই তাদের নিজস্ব একটা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হতে পারে।

সবাই যখন হাল ছেড়ে দেয়, তারা হাল ছাড়ে না। এই অসাধারণ বিষয়টি সম্ভবত আমাদের রক্তের ভেতর আছে, এই কারণেই মনে হয় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে একটি দেশ পেয়েছিলাম। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমাদের দেশ কখনো তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্যটুকু পায় না। তারা দেশকে চালিয়ে নেয়, যাদের আমরা বলি সাধারণ মানুষ, তাদের ভালোবাসা আর আন্তরিকতায় এই দেশটি টিকে আছে। 

আমাদের এই তরুণ সমাজকে আমার সেল্যুট। যখন রানা প্লাজা ধসে পড়েছিল তখন আরেকবার আমরা এই তরুণ প্রজন্মের অসাধারণ ভূমিকা দেখেছিলাম। আমার মনে আছে আমি তখন তরুণ সেই স্বেচ্ছাসেবকদের এমন কিছু ভূমিকার কথা শুনেছিলাম যেটি বিশ্বাস করা কঠিন। আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখি, কিন্তু আমি জানি সেই স্বেচ্ছাসেবকদের অভিজ্ঞতায় বিষয়গুলো যদি আমি হুবহু লিখি কেউ সেগুলো সত্যি বলে বিশ্বাস করবে না। 

সবারই নিশ্চয়ই মনে আছে অসংখ্য শ্রমিকের হাত পা ভাঙা কংক্রিটের নিচে চাপা পড়েছিলো, তাদের বাঁচানোর একটি মাত্র উপায় সেই কংক্রিটে আটক পড়া হাত কিংবা পা কেটে বাকি মানুষটিকে নিয়ে আসা। সেই ভয়ংকর সার্জারি কারা করেছিলো? তাদের হাতে বেদনানাশক ইনজেকশনের একটা সিরিঞ্জ আর একটা হ্যান্ড স (ধাতব জিনিস কাটার উপযোগী করাত) দিয়ে দেয়া হতো, তারা সেই ইনকেজশন দিয়ে হাত কিংবা পা কেটে মানুষটিকে ছুটিয়ে এনেছে। তারপর তাদের ঘাড়ে করে ধসে পড়া সেই রানা প্লাজার ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে বের করে এনেছে। 

পুরো ভবনটি ছিলো একটা বিপজ্জনক জায়গা, ধসে পড়া অংশগুলো নড়ছিলো, যেকোনো মুহূর্তে আর‍ও ধসে পড়ার আশংকা ছিলো। অন্ধকার সেই মৃত্যুপুরীর বিভীষিকা থেকে তরুণেরা একজন একজন করে শ্রমিককে মৃত্যুর অন্ধকার থেকে জীবনের আলোতে নিয়ে আসছিলো। 

সবাইকে আনতে পারেনি— অনেক শ্রমিক এমন জায়গায় আটকা পড়েছিলো যেখান থেকে তাদের কোনোভাবেই উদ্ধার করে আনা সম্ভব ছিলো না। সেই তরুণেরা তাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করেছে— তারা যখন একজন একজন করে মারা গিয়েছে সেই অন্ধকার কুঠুরিতে তরুণেরা তাদের পাশে থেকেছে। আমি সেই দৃশ্যগুলোর কথা চিন্তা করতে পারি না। সেই অসাধারণ তরুণদের আমি মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানাই। 

শিশু জিহাদের বেলাতেও আমরা সেই একই ধরনের তরুণদের দেখেছি। এই রাষ্ট্রযন্ত্র ‘তুচ্ছ’ একটি শিশুর জীবনকে উপেক্ষা করে পুরো বিষয়টুকুতে সরকারের ভাবমূর্তিকে উদ্ধার করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। অতীতের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে যখন তারা একইভাবে হৃদয়হীন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলো তখন এই তরুণেরা সবকিছু ভুলে সেই শিশুটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে গেছে। আমরা শিশু জিহাদকে ফিরে পাইনি কিন্তু তার দেহটিকে উদ্ধার করার কারণে তাকে সম্মানজনকভাবে শেষ বিদায় দেয়া গেছে, তার আপনজনদের অসম্মান থেকে উদ্ধার করে শিশুটির জন্যে শোক করার একটি সুযোগ করে দেওয়া গেছে। 

এই লেখাটি যখন প্রকাশ পাবে তখন আমরা নতুন বছরে পা দেবো। আমার ইচ্ছে ছিলো সবাইকে নতুন বছরের নতুন কোনো স্বপ্ন দেখিয়ে কিছু লিখবো। কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসে মনে হলো যে দেশে আমাদের এই তরুণেরা আছে সেই দেশের মানুষের কি আলাদা করে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে হয়? এই তরুণেরাই কি আমাদের স্বপ্ন নয়?

ঢাকা জার্নাল, জানুয়ারি ০২, ২০১৫ 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.