কী কথা তাহার সনে

ডিসেম্বর ৬, ২০১৪

Khaledaঢাকা জার্নাল : রাতভর নাটকীয়তার পরেও কৌতূহল দূর হয়নি। উল্টো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে আরো কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। 

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান খানিকটা স্পস্ট করলেও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। আর তা নিয়েই সবার মনে প্রশ্ন- খালেদার সঙ্গে সচিবালয়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কী এমন কথা রয়েছে!

বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় এলাকায় আনাগোনা শুরু হয় সচিবালয়ের ওএসডি (জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এবং কর্মচারীদের। বিষয়টি তখনও মিডিয়া কর্মীরা নিশ্চিত হতে পারেননি। 

শুধু এই টুকু নিশ্চিত হন যে, ওএসডি কর্মকর্তাদের বিএনপিপন্থী একটি অংশ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন, তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে। তবে আদৌও বৈঠক করবেন কিনা তা তখনো নিশ্চিত নন তারা।
 
এদিকে, এ খবর জানার পর বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তৎপর হয়। রাত সাড়ে আটটায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক হওয়ার কথা এমন খবরে সন্ধ্যার আগেই গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ছুটে যান খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে। একইভাবে অন্য গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও ছুটে যান সেখানে।

সচিবালয় থেকে আন্দোলন!
বৈঠক নিয়ে কৌতূহল ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বেশি থাকার কারণ ছিল; বিগত আওয়ামী লীগের মতো মঞ্চ বা অন্য কোনোভাবে বিএনপি দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করতে চায়। তবে এর আগে সচিবালয়ের বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা কয়েক দফা এ ধরনের উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। 

সচিবালয় থেকে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করতে চায় বিএনপি। আর সে কারণেই বৃহস্পতিবার বর্তমান ও সাবেক আমলাদের নিয়ে খালেদা জিয়ার বৈঠক হবে, এমন খবরেই বেশি মনোযোগী হন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। 

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, সামরিক উপদেষ্টাসহ খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার বৈঠকে উপস্থিতি, সাবেক ও বর্তমান আমলাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি মিডিয়াকর্মীসহ সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কিছু একটা হতে যাচ্ছে! অন্তত, এইটুকু পরিস্কার যে, বিএনপিপন্থী ওএসডি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে বিএনপির আন্দোলন চাঙ্গা করতেই এই বৈঠক। আর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার উপস্থিতিতে আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ হতে পারে গোপন এই বৈঠকে। 

মিডিয়া এড়িয়ে!
বিভিন্ন সময় বিএনপির গোপন বৈঠকও প্রচার করতে মিডিয়াকে জানান দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু বৃহস্পতিবারের এই বৈঠক সম্পর্কে বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের কাছেও গোপন রাখা হয়। বিভিন্ন সময় গোপন বৈঠকে মিডিয়া কর্মীদের অন্তত কার্যালয়ের বাউন্ডারির মধ্যেই জায়গা হয়েছে। কিন্তু এই বৈঠকে কার্যালয়ের বাউন্ডারির ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি কোনো মিডিয়াকর্মীকে।

রাত সাড়ে আটটার সময় বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে বৈঠক করবেন সচিবালয়ের ওএসডি কর্মকর্তারা। সন্ধ্যা সাতটা থেকেই গুলশান কার্যালয়ের আশেপাশে আনাগোনা তাদের। কেউ কেউ আগে থেকেই ভেতরে আছেন, এমন খবর ছিল মিডিয়াকর্মী ও গোয়েন্দাদের কাছে। 

তবে সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটের দিকে সচিবালয়ের চারজন কর্মকর্তা প্রবেশ করেন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে। তখনও খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে পৌঁছাননি। কিছুক্ষণ পর ৬ থেকে ৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রবেশ করেন। এ সময় ছাত্রদলের কর্মীদের উপস্থিতি ছিল গেটের কাছেই। 

আলো-আঁধারের মধ্যে আটটার আগেই আরো জনা দশেক কর্মকর্তা প্রবেশ করেন কার্যালয়ের ভেতরে। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও তখন আরো অনেকেই প্রবেশ করেন কার্যালয়ে। সব মিলিয়ে ৩০ জনের বেশি রয়েছেন যাদের খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে সচরাচর দেখা যায়নি। এমনকি গেটের সামনে উপস্থিত বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের কাছে বেশিরভাগই অপরিচিত। শেষরক্ষা দু-একজন তাদের অনেককেই চেনেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবিও নিয়েছেন একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। আলো-আধাঁরে কম-বেশি ভিডিও ধারণ করতেও দেখা গেছে। 

পরিচয় গোপনের চেষ্টা!
এ সময় বিভিন্ন মিডিয়ার কর্মীদের ছুটে আসতে দেখা যায়। খালেদা জিয়ার আসার আগেই প্রায় বেশির ভাগ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা তৎপর যান। সচিবালয়ের আব্দুল হান্নান নামে এক কর্মকর্তার পিছু নেন মিডিয়া কর্মীরা। নাম-পরিচয় গোপন করেই পালানোর চেষ্টা করেন ওই কর্মকর্তা। সংবাদকর্মীদের চাপাচাপিতেও কোনো কাজ হয়নি। এক পর্যায়ে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন ওই কর্মকর্তা। 

এরপর থেকে অপরিচিত লোক দেখলেই তার দিকে ছুটে যান সংবাদ কর্মীরা। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই মিডিয়াকর্মীরা তার দিকে এগিয়ে গেছেন। পরিচয় জানতে চাইলেও কোনো ব্যক্তিই তার পরিচয় দেননি। কোনো না কোনোভাবে চলে গেছেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে। 

পরিচয় না থাকার কারণে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাকে গিয়েও ঘিরে ধরেন সংবাদকর্মীরা। অবশ্য পরিচয় পেয়ে সংবাদকর্মীরা ছোটেন অন্যদিকে। এভাবে খালেদা জিয়ার একাধিক উপদেষ্টা বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়েন। তারপরেও সরকারি আমলা ধরতে রাতভর দৌড়াদৌড়ি। এক পর্যায়ে টিভি ক্যামেরার আঘাতে এনটিভির এক ক্যামেরাপার্সনের নাক ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। 

বৈঠক নিয়ে নাটকীয়তা!
রাত আটটা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে এই নাটকীয়তা। রাত সোয়া ৯টায় পৌঁছান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার দুই মিনিট পর খালেদা জিয়া পৌঁছান তার কার্যালয়ে। সাড়ে ৯টার দিকে বৈঠক শুরু হয়। রাত ১০টার দিকে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে গোপন বৈঠক শেষ হয়েছে এমন খবর আসে মিডিয়াকর্মীদের কাছে। 

সোয়া ১০টার দিকে খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাবেক আমলা ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্ত‍ারা দেখা করতে এসেছিলেন। তবে এটি কোনো বৈঠক নয়। 

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা (সরকারি কর্মকর্তা) তো আসতেই পারেন। সারাদিনই তো মানুষজন এসেছে। আর সাবেক কর্মকর্তারা তো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণেই এসেছেন।

সরকারি কর্মকর্তারা এমন বৈঠক করতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাহলে ‘জনতার মঞ্চ’ হয়েছিল কীভাবে! তখন তো সার্ভিস রুল ভঙ্গ হয়নি!  

রাত ১২টার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন। 

তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে মির্জা ফখরুলের পক্ষে বিএনপির সহদফতর সম্পাদক শামীমুর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি ধরিয়ে দেওয়া হয় মিডিয়াকর্মীদের হাতে। তবে এতে মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদে জনগণকে বিভ্রান্ত্র না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। 

খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খানের বক্তব্য এবং মির্জা ফখরুলের অস্বীকার আরো কৌতূহল বাড়িয়ে দেয় সাংবাদিকদের। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাধারণ কোনো গোপন বৈঠক নয়, বিশেষ বৈঠকই হয়েছে। ‘ডালমে কুচ কালা’ যোগ করেন একজন মিডিয়াকর্মী। বিএনপির আন্দোলনের প্রস্তুতিই এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য; তা না হলে কী কথা রয়েছে, সরকারি-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে! 

রাত ১২টা ৪০ মিনিটে খালেদা জিয়া বের হয়ে যান কার্যালয় থেকে। তখনও অপেক্ষা সংবাদকর্মীদের। কারণ, তখন কার্যালয়ে সচিবালয়ের ওএসডি কর্মকর্তারা রয়েছেন এমনই ধারণা সংবাদকর্মীদের। 

মিডিয়া ভীতিতে আমলারা!
একের পর এক করে অনেক কর্মকর্তা বের হয়ে আসলেও যতজন ঢুকেছেন, ততজন বের হননি। এক পর্যায়ে রাতে আর কেউ বের হবেন না এমন তথ্যের ভিত্তিতেই রাত পৌনে একটার দিকে বেশিরভাগ মিডিয়াকর্মী ফিরে যান গুলশান থেকে।

ঢাকা জার্নাল, ডিসেম্বর ৫, ২০১৪।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.