নিজামীর ফাঁসির আদেশ

অক্টোবর ২৯, ২০১৪

Mowlana_Nizami_441622522মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির একাত্তরে কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ আজ বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন।

ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় এই মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

রায় ঘোষণা উপলক্ষে নিজামীকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ জন্য গতকাল সন্ধ্যায় তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। দীর্ঘসূত্রতা: ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম। এর রায়ও অপেক্ষমাণ ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। নিজামীর মামলার রায় পড়া শুরু গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় এ মামলার কার্যক্রম শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে এই রায়ের জন্য অপেক্ষার শুরু।

রায় ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর। এর ৫৩ দিন পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শোনেন। ২৪ মার্চ মামলাটি দ্বিতীয় দফায় রায়ের অপেক্ষায় (সিএভি-কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখা হয়।

এর তিন মাস পর ২৪ জুন রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার দিন সকালে কারাগারে আটক নিজামী হঠাৎ ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ ট্রাইব্যুনালকে জানায়, তাঁকে হাজির করা সম্ভব নয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসংগত নয়। এ জন্য মামলাটি আবারও রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়। ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, আসামি সুস্থ হয়ে উঠলে যত দ্রুত সম্ভব রায় ঘোষণা করা হবে। ৩ জুলাই নিজামীর সুস্থতার প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। এর প্রায় চার মাস পর গতকাল দ্বিতীয় দফায় এই রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।

রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো।২০১২ সালের ২৮ মে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলায় নিজামীর বিচার শুরু হয়। প্রায় দেড় বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। এই মামলার দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ, একই সময়ে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলারও বিচার চলছিল। এ জন্য ওই মামলার অন্যতম আসামি নিজামীকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নেওয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। গত ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের দাবি: মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা আশা করে রাষ্ট্রপক্ষ। নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার দাবি করেন তাঁরা। একই সঙ্গে এসব অপরাধ সংঘটনে নিজামীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায়ও প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ। পক্ষান্তরে আসামিপক্ষ দাবি করে, মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এসব অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। এ জন্য নিজামীকে খালাস দেওয়া উচিত। ফিরে দেখা: ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী ১৯৭১ সালে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন, বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন।

অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ বলে, নিজামী একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিজামী নিরাপত্তা: রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন। হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে প্রবেশের সবগুলো ফটকে পুলিশ ও র‌্যাব অবস্থান নেয়। ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তল্লাশিও করা হয়। দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট মাজার পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

হাইকোর্ট মাজার ফটকের বাইরে অবস্থান নেয় পুলিশের সাঁজোয়া যান। শাহবাগ মোড়েও অবস্থান নেয় পুলিশ। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ রাজধানীসহ দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। গতকাল রাত থেকেই রাস্তায় নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান গতকাল জানান, নিজামীর রায়কে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগরে থাকছে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা। থাকছে তল্লাশি চৌকি, অতিরিক্ত টহল। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, ঢাকার বাইরের জেলাগুলো বিশেষ করে যেসব জায়গায় গত বছর ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও হয়েছিল, সেসব জেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার: নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে দুটি ট্রাইব্যুনাল এ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি মামলার রায় ঘোষণা করলেন। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-২ ছয়টি এবং ট্রাইব্যুনাল-১ চারটি মামলার রায় দিয়েছেন। দুই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়গুলোর মধ্যে তিনটি ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। আর গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল-২-এর দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ১২ ডিসেম্বর রাতে ওই রায় কার্যকর করা হয়।

এ ছাড়া বিএনপির সাবেক নেতা আবদুল আলীম মারা যাওয়ায় তাঁর মামলাটি আপিল বিভাগ বাতিল করেছেন। ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনাল-১-এর রায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমও কারাগারে আটক অবস্থায় ২৩ অক্টোবর মারা যান। নিয়ম অনুসারে আপিল বিভাগে বিচারাধীন তাঁর মামলাটিও আর চলবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলবদর বাহিনীর দুই নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান, জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদ, বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.