মুজিবকে স্মরণ করছে বাংলাদেশ

আগস্ট ১৫, ২০১৪

mujibঢাকা জার্নাল: বছর ঘুরে আবারো এসেছে বাঙালি জাতির সেই শোকাবহ দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতি একইসঙ্গে স্মরণ করছে তার পরিবারের নিহত সদস্যদেরও।

১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে। ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি তার পরিবারের ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও।

সপরিবারে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের এই দিন জাতীয় শোক দিবস। তাই ১৫ অগাস্ট সরকারি ছুটির দিন। সরকারের পাশাপাশি দিবস উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

শুক্রবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার মধ্য দিয়ে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করার পাশাপাশি তোলা হয় কালো পতাকা।

সকাল পৌনে ৭টায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সশস্ত্র সালাম জানায়। বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। পরে কোরআন থেকে তেলাওয়াত করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

এরপর দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে লাইনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান হাজারো মানুষ।

১৫ অগাস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

 সেই রাতের ঘটনাকে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধূর ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসাবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “এ দেশ ও জনগণ যতদিন থাকবে ততদিন জাতির পিতার নাম এদেশের লাখো-কোটি বাঙালির অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।”

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করতে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানোর কথাও বলেছেন রাষ্ট্রপতি।

শোকাবহ স্মৃতির দুয়ারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতার দূরদর্শী, সাহসী এবং ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সংগীত।

“ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও তিতীক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ বাঙালি জাতির অন্তরে প্রোথিত হয়ে আছে।”

৩৯ বছর আগে সেই রাতে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ছাড়াও স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে।

সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।

ধানমণ্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।

বনানী কবরস্থানে তাদের কবরে সকাল সাড়ে ৭টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা। পরে সেখানে মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল হয়।

প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সকাল ১০টায় টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান।

জুমার পর দেশের সব মসজিদে মিলাদ ও দোয়া হবে। এছাড়া মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জাসহ সব উপসনালয়ে হবে বিশেষ প্রার্থনা।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। আছরের পর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে হবে মহিলা আওয়ামী লীগের মিলাদ মাহফিল।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শনিবার বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ।

সংবাদপত্রগুলো শোক দিবস উপলক্ষে শুক্রবার সকালে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠান।

এছাড়া শিল্পকলা একাডেমিতে দুই দিনব্যাপী প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ফিল্ম আর্কাইভ।

সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোতে শুক্রবার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার পাশাপাশি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি।

এরপর বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ছেষট্টির ছয় দফা প্রণয়নে ভূমিকা রেখে এবং ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।

১৯৬৯ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্ররা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দেন তিনি।

তার নেতৃত্বে রক্তাক্ত সংগ্রামেই অভ্যূদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। আর স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের।

দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৭৫-এর পর ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পালিত হয়ে আসছে ১৫ অগাস্ট। ’৭৫ এর পর ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালিত হয়নি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ১৫ অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পরবর্তী পাঁচ বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালিত হয়।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এসে জাতীয় শোক দিবস বাতিল করে দেয়। একই সঙ্গে জাতীয় পতাকা বিধি সংশোধন করে সরকারিভাবে নির্ধারিত দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

২০০২ সাল থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মসূচির মধ্য দিয়েই দিবসটি পালন করে।

পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হাই কোর্টের এক রায়ে ২০০৮ সাল থেকে দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাসের নৃশংসতম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের আবাসিক একান্ত সহকারী মহিতুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করেন। সে বছরের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদে বিলোপ করা হয়।

পরের বছরের ১৫ জানুয়ারি এ হত্যাকাণ্ডে ১৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দীর্ঘ ১৪৯ দিন সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

এরপর ২০০০ সালের ২৮ জুন হাই কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ‘ডেথ রেফারেন্স’ ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। ২৮ নভেম্বর শুনানি শেষে ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টের দুই বিচারপতি দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। পরের বছর ৩০ এপ্রিল তৃতীয় একক বিচারপতি ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

কিন্তু এই রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে হাই কোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়।

দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৯ সালের ৭ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিলের শুনানি শুরু হয়।

ওই বছর ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাই কোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করে।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ আবেদন খারিজ হলে পরদিন সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি সাতজনের মধ্যে এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেমউদ্দিন ও আব্দুল মাজেদ অবস্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন দেশে আছেন। আর আব্দুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১৫, ২০১৪।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.